স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিটি তলায় তলায় দুর্নীতি

রাজধানীর মহাখালীর কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পুরনো ভবনটি স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রিক দুর্নীতির ঘাঁটি বলেই বছরের পর বছর ধরে জানে এ খাতের প্রায় সবাই। তবে সময়ের সঙ্গে বদলেছে টেন্ডারবাজি আর কেনাকাটার প্রক্রিয়াগত ধরন,

বদলেছে চেয়ারের মানুষ; এমনকি বদলেছে কার্যালয়েরও অংশবিশেষ। পুরনো ভবন থেকে কিছু বিভাগ গেছে নতুন ভবনে। তবে এখনো দুর্নীতির বেশির ভাগ ক্ষেত্র রয়ে গেছে পুরনো ভবনের তলায় তলায়।

কেউ কেউ বলেন, এই ভবনের বেশির ভাগ কক্ষেই চলে কোনো না কোনো ধরনের দুর্নীতি। প্রয়োজন মতো নতুন ভবনেও গড়ায়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির কারিগর বলে পরিচিত আফজাল থেকে শুরু করে সদ্য ধরা পড়া গাড়িচালক মালেক—সবাই এই পুরনো ভবন ঘিরেই তাঁদের মূল রাজত্ব করেছেন।

গতকাল বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ঘুরে বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় নানা ধরনের, নানা জনের বহুরকম দুর্নীতির তথ্য, অভিযোগ আর গুঞ্জন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিভিন্ন পদের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা জানান, গত কয়েক বছরে অনেক ধরনের অদল-বদল হলেও দুর্নীতি রয়ে গেছে আগের মতোই। পাল্টেছে শুধু কিছু কৌশল। যা দিনে দিনে বেরিয়েছে বিভিন্ন সংস্থার অনুসন্ধান ও ধরপাকড়ের মধ্য দিয়ে।

তবে অনুসন্ধানের চোখ এড়িয়ে অনেকেই আবার দিব্যি টিকে যাচ্ছেন; চালিয়ে যাচ্ছেন দুর্নীতি। আর এসব কাজে অধিদপ্তরের বড় পদের কর্মকর্তাদের কেউ কেউ যেমন জড়িত ছিলেন,

আবার কেউ জড়িত না থাকলেও প্রশ্রয় দিয়ে গেছেন নিজের চেয়ার ঠিক রাখার স্বার্থে। আর এই সুযোগে নিচের বিভিন্ন পদে চলেছে এবং এখনো চলছে বেপরোয়া দুর্নীতি। কেউ দুর্নীতি করেন কেনাকাটায়,

কেউ নিয়োগ-বদলিতে, কেউ বা বিভিন্ন কর্মসূচি বা প্রকল্পের আওতায় থাকা প্রশিক্ষণ, সচেতনতা কিংবা গবেষণা কার্যক্রমে। আরেক ধরনের প্রায় অপ্রতিরোধ্য দুর্নীতি চলছে সারা দেশের চিকিৎসক ও চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি,

বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন, পদন্নোতি ও পেনশন বিষয়ক নানা ধরনের ফাইল চালাচালি ঘিরে। সেই সঙ্গে আছে কর্মকর্তাদের গাড়ি কিংবা সরকারি বাসভবন প্রাপ্তির ইস্যুগুলোও।

কর্মকর্তারা জানান, গাড়িচালক মালেকের মতো কেউ কেউ আছেন একাধারে কয়েক ধরনের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। বিশেষ করে গত প্রায় ২৫ বছরে পাঁচটি সরকারের আমলে তিন-চারজন মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই দুর্নীতির অভিযোগ ছিল।

এঁদের একজন মারা গেছেন এবং দুজন এখনো জীবিত আছেন। বাকিদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে জোরালো দুর্নীতির অভিযোগ না থাকলেও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

দুর্নীতিতে সরাসরি যুক্ত থাকার সবচেয়ে বেশি অভিযোগ উঠেছে গাড়িচালক মালেককে সুবিধা দেওয়া সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেনের বিরুদ্ধে।

অন্যদিকে দুর্নীতির প্রশ্রয়দাতা হিসেবে সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. শেফায়েত উল্লাহ, অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ ও বর্তমান স্বাস্থ্য শিক্ষার মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ কে এম এনায়েত হোসেনের নামও ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে।

বিশেষ করে অধ্যাপক ডা. এ কে এম এনায়েত হোসেন কিভাবে গত চার বছর ধরে মালেকের মতো একজন গাড়িচালককে তাঁর সঙ্গে রেখেছেন তা নিয়ে ঘুরপাক ঘাচ্ছে নানা প্রশ্ন।

একইভাবে সাবেক আরেক মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ কিংবা তাঁর আগের মহাপরিচালক শেফায়েতুল্লাহ এই মালেক কিংবা আফজালের মতো বড় চক্রের হোতাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেননি সেই প্রশ্নও উঠছে।

এ ছাড়া এই মহাপরিচালকদের সময় নিচের কর্মচারী ছাড়াও ওপরের দিকে বেশ কয়েকজন পরিচালক, উপপরিচালক, কর্মসূচি ব্যবস্থাপক, কর্মসূচি উপব্যবস্থাপকদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

বরং তাঁদেরকে রীতিমতো সঙ্গে রেখে বড় বড় দুর্নীতির প্রশ্রয় দিয়ে যাওয়া হয়েছে বছরের পর বছর। যে সুযোগে বিভিন্ন প্রকল্পের ঠিকাদারচক্র এসব কর্মকর্তার যোগসাজশে শত শত কোটি টাকার কাজ নিয়ে নয়ছয়ে মেতে ছিলেন।

যার প্রমাণ মিলছে দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রকাশিত একের পর এক তালিকা থেকে। করোনার আগে যেমন একদিকে স্বাস্থ্য খাতের ঠিকাদার সিন্ডিকেটের গডফাদার হিসেবে মিঠু চক্রের নাম বেরিয়ে আসে, আফজালসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা হয়।

কারাগারেও যান আফজালসহ কয়েকজন, অন্যদিকে আরো ১৪টি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। এর পরই করোনাকালে দুর্নীতি ও অনিয়মের জন্য ঘটে বড় তোলপাড়; সরে যেতে হয় মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদকে।

পরিস্থিতির মুখে পদ থেকে সরিয়ে ওএসডি করা হয় একাধিক পরিচালককে, বদলি করা হয় কাউকে কাউকে। গতকালও মামলা হয়েছে হাসপাতাল শাখার পরিচালকসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে।

সেই সঙ্গে গাড়িচালক মালেকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ১২ জনের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে আইনি প্রক্রিয়া। তবে এখনো অনেকেই আইনের আওতার বাইরে রয়ে গেছেন।

এসব বিষয়ে সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন দাবি করেন, তাঁর সময় মন্ত্রী ও সচিবের নির্দেশনা অনুসারে নিয়মনীতির মধ্যেই সব কাজ করেছেন। নিয়োগেও অনিয়ম হয়নি। মালেকের অপকর্মের বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না।

সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদও প্রায় একই কথা বলেন : মালেক আমার গাড়ি চালায়নি। আমি তাকে আমার কাছে ঘেঁষতেও দেইনি। এ ছাড়া আমার সময়েই দুদকের সহায়তায় অনেক ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়ম রোধে পদক্ষেপ নিয়েছি। সিসিটিভি ক্যামেরা লাগিয়েছি।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছি অফিসের ভেতরে ও বাইরে। যারা দুর্নীতিতে জড়িত ছিল তাদের অনেকের বিষয়েই বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছি কখনো মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কখনো নিজে। এ ছাড়া দুদককে সব সময় সহযোগিতা করেছি বলেই গত কয়েক বছরে দুর্নীতিবাজ অনেকে ধরা পড়েছে।

স্বাস্থ্য শিক্ষার বর্তমান মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ কে এম এনায়েত হোসেন বলেন, ‘মালেক আমার গাড়ি চালালেও তার অপকর্মের বিষয়ে কিছুই জানতাম না। আর আমি নিজে কোনো দুর্নীতির সঙ্গে নেই, দুর্নীতিকে আমি কখনো প্রশ্রয় দেই না।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে গতকাল পুরনো ভবনের একাধিক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, অধিদপ্তরের প্রবেশের প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকেই ডান পাশে ছিল সদ্য ধরা পড়া গাড়িচালক মালেকের ঘাঁটি।

অ্যাসোসিয়েশনের নামে এই ঘরটিকে তাঁর কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করেই চলত দুর্নীতির ছক তৈরির কাজ। বাম পাশে তথ্য ব্যবস্থাপনা বা এমআইএস ভবনের একাধিক কক্ষেও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত আছেন এমন কারো কারো নাম আলোচনায় আছে আগে থেকেই।

বিশেষ করে স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোর একাধিক কর্মকর্তাকে নিয়ে এই আলোচনা বেশি। অন্যদিকে আরেকটু সামনে এগিয়ে গাড়িচালক মালেকের নিয়ন্ত্রণাধীন ক্যান্টিনে বসেই চলে বাইরে থেকে বিভিন্ন কাজে আসা চিকিৎসক বা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে

অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট নিচের দিকের কর্মচারীদের দেনদরবার বা গোপন আলাপ-আলোচনা। এর সামনেই মূল ভবনের নিচতলায় ওয়েটিং রুমেও চলে প্রায় একই ধরনের কর্মকাণ্ড। কয়েক বছর ওই ভবন দুর্নীতিমুক্ত করার লক্ষ্যে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো হয়।

ফলে সিঁড়িতে কিংবা বিভিন্ন তলার করিডরে লেনদেনের দৃশ্য কমে গেছে। এর বদলে এখন বিভিন্ন রুমের দরজার আড়ালে চলে আলাপ-আলোচনা।

দ্বিতীয় তলায় আলোচিত কর্মচারী রিয়াজকে নিয়ে ব্রিবত হয়ে আছেন তাঁর দপ্তরের কর্মকর্তারা। তৃতীয় তলায় স্বাস্থ্য শিক্ষার একজন অতিরিক্ত মহাপরিচালকের সঙ্গে থাকা কর্মচারী আনোয়ার আর বাজেট শাখার উচ্চমান সহকারী আতিকুলের বিরুদ্ধেও অভিযোগের কমতি নেই।

চতুর্থ তলায় বেপরোয়া ইয়াছিনের নাম আছে কর্মচারীদের মুখে মুখে। ষষ্ঠতলায় চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী মোসলেমের নাম শুনলেই আঁতকে ওঠেন কেউ কেউ। পঞ্চম তলায় জালালের নামও এসেছে দুদকের তালিকায়।

নতুন ভবনের প্রতি তলায়ই আছেন দুর্নীতিতে আলোচিত কেউ না কেউ। এর মধ্যে তৃতীয় তলায় প্রশাসনিক কর্মকর্তা এ কে এম আজিজুল হক, অফিস সহকারী শাহনেওয়াজ, সফিকুল ইসলাম, রফিকুল ইসলাম, পরিচালক-পার ১ ও ২-এর দপ্তরের অফিস সহায়ক আছর উদ্দিনের নামও আছে আলোচনায়।

অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে থাকা সিডিসির উপপরিচালক জহিরুল করিম আর অসক্রামক ব্যাধির পিএম ডা. আব্দুল আলিম ও ডিপিএম সারোয়ারুল আলম মিলনের নামেও বিভিন্ন প্রকল্পে নয়ছয় করার অভিযোগের কথা জানে অধিদপ্তরের অনেকেই।

2021-01-30 06:29:31

0000-00-00 00:00:00

Published
Categorized as 17

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *