আল্লাহ তায়ালা বলেন,
হে ঈমানদার লোকেরা, তোমরা নিজেরা যা অর্জন করেছো, সে পবিত্র (সম্পদ) এবং যা আমি যমীনের ভেতর থেকে তোমাদের জন্যে বের করে এনেছি, তার থেকে (একটি) উৎকৃষ্ট অংশ (আল্লাহর পথে) ব্যয় করো, (আল্লাহর জন্যে এমন) নিকৃষ্টতম জিনিসগুলো বেছে রেখে তার থেকে ব্যয় করো না, যা অন্যরা তোমাদের দিলে তোমরা তা গ্রহণ করবে না, অবশ্য যা কিছু তোমরা অনিচ্ছাকৃতভাবে গ্রহণ করো তা আলাদা, তোমরা জেনে রেখো, আল্লাহ তায়ালা (তোমাদের দানের) মুখাপেক্ষী নন, সব প্রশংসার মালিক তো তিনিই।
(সূরা আল-বাক্বারা:আয়াত,২৬৭)
ঈমানও সালাতের পরে যাকাত ইসলামের তৃতীয় স্তম্ভ। অনেক ইবাদতই কুরআন
কারীমে মাত্র ২/৪ বার উল্লেখিত হয়েছে, যেমন রােযা, হজ্জ ইত্যাদি। আবার কিছু ইবাদত অনেক বেশী
বার উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআনে একবার বললেই ফরয হয়ে যায়। বারবার বলার অর্থ গুরুত্ব
বুঝানাে। সালাতের পরে সবচেয়ে বেশী যাকাতের কথা কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা সাধারণত
দীনের সবচেয়ে বড় কাজ বুঝাতে বলি “নামায-রােযা”, কিন্তু কুরআনে কোথাও “নামায-রােযা বলা
হয় নি, সব সময় বলা হয়েছে নামায-যাকাত। রােযা হলাে যাকাতের পরে। যাকাত না দেওয়া
কাফিরদের বৈশিষ্ট্য ও জাহান্নামের শাস্তির অন্যতম কারণ। আল্লাহ বলেন:
“ধ্বংস মুশরিকদের জন্য, যারা যাকাত প্রদান করে না, আর যারা আখেরাতে অবিশ্বাস করে। (সুরা ফুসসিলাত (৪১): আয়াত ৬-৭।)
কুরআনে বলা হয়েছে, জাহান্নামীগণকে প্রশ্ন করা হবে: কিজন্য তােমরা জাহান্নামে শান্তি ভােগ
করছ? তারা তাদের কুফুরীর উল্লেখের সাথে সাথে নামায ও যাকাত ত্যাগের কথা বলবে। তারা বলবে:
“আমরা সালাত পালনকারীগণের মধ্যে ছিলাম না। আর আমরা দরিদ্রগণকে খাওয়াতাম না।” (সুরা আল- মুদ্দাসসির (৭৪): আয়াতঃ ৪২-৪৩।)
আমরা মনে করি, বৈধ-অবৈধভাবে মাল বৃদ্ধি করলে এবং সঞ্চয় করলেই সম্পদশালী হলাম। কিন্তু
আল্লাহ বলেন উল্টো কথা। ব্যয় করলেই আল্লাহ বৃদ্ধি করেন। আপনি দুয়ে দুয়ে চার গুণেছেন। কিন্তু কার
জন্য গুণলেন? আপনার জন্য না সন্তানদের জন্য? আল্লাহ বরকত নষ্ট করে দিলে কিছুই থাকবে না। কিভাবে
বরকত নষ্ট হবে তা আপনি বুঝতেও পারবেন না। আল্লাহ তাঁর ওয়াদা ভঙ্গ করেন না। আল্লাহ বলেন:
“আল্লাহ সুদের বৃদ্ধিকে ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন করেন আর ‘সাদাকাহ বা যাকাতকে বৃদ্ধি করেন। (সুরা বাকারা: ২৭৬ আয়াত।)
“এবং তােমরা মানুষের সম্পদ বৃদ্ধির জন্য যে বৃদ্ধি (সুদ) প্রদান কর তা আল্লাহর নিকট বৃদ্ধি পায় না। আর আল্লাহর সম্ভুষ্টি অর্জনের জন্য তােমরা যে যাকাত প্রদান কর সেই যাকাতই হল বহুগুণ বৃদ্ধিকারী। (সুরা রূমঃ ৩৯ আয়াত।)
আরাে কয়েকটি সহীহ হাদীস শুনুন:
যে ব্যক্তি তিনটি কাজ করবে সে ঈমানের স্বাদ ও মজা লাভ করবে: যে একমাত্র আল্লাহর
ইবাদত করবে, জানবে যে আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই এবং আনন্দিত চিত্তে পবিত্র মনে তার
সম্পদের যাকাত প্রদান করবে। (আবু দাউদ, আস-সুনান ২/১০৩: আলবানী, সহীহত তারগীব ১/১৮৩)
রাসুলুল্লাহ ( সা.) বলেছেন,
“তিনটি বিষয় আমি শপথ করে বলছি: যে ব্যক্তির ইসলামে অংশ আছে আর যার ইসলামে কোন অংশ নেই দুইজনকে আল্লাহ কখনােই সমান করবেন না। ইসলামের অংশ তিনটি: সালাত, সিয়াম ও যাকাত।”
(হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/৬৭: হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১/৩৭: আলবানী সহীহত তারগীৰ ১৮৯, ১৮১। হাদীসটি সহীহ)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
“যে তার সম্পদের যাকাত প্রদান করে, তার সম্পদের অকল্যাণ ও অমঙ্গল দূর হয়ে যায়। (হাইসামী, মাজমাউষ যাওয়াইদ ৩/৬৩; আলবানী, সহীহত তারগীব ১/১৮২। হাদীসটি হাসান)
প্রথম যে তিন ব্যক্তি জাহান্নামে প্রবেশ করবে তাদের একজন হলাে যাকাত প্রদান থেকে বিরত সম্পদশালী মুসলিম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
“প্রথম যে তিন ব্যক্তি জাহান্নামে প্রবেশ করবে তারা হলাে: সেচ্ছাচারী শাসক বা প্রশাসক,
সম্পদশালী ব্যক্তি যে তার সম্পদে আল্লাহর যে অধিকার (যাকাত) তা প্রদান করে না এবং পাপাচারে
লিপ্ত দরিদ্র ব্যক্তি।( ইবনু হিক্বান, আস-সহীহ ১০/৫১৩: হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/৫৪৪; আলবানী, সহীহত তারগীব ২/৬৬। হাদীসটি সহীহ)
যাকাত প্রদান থেকে যে মুসলিম বিরত থাকে বা যাকাত দিতে টালবাহনা ও দ্বিধা করে
তাকে হাদীসে অভিশপ্ত বা মালউন বলা হয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রা.) বলেন:
“সুদ গ্রহণকারী, সুদ প্রদানকারী, সুদের লেখক, সুদের সাক্ষীদ্বয়- যদি তা জেনেশুনে করে,
সৌন্দর্যের জন্য যে নারী নিজের দেহে উদ্কধিকাটে বা অন্যের দেহে উল্কি কেটে দেয়, যাকাত প্রদানে যে
ব্যক্তি টালবাহনা করে বা বিরত থাকে এবং হিজরত করার পরে আবার যে ব্যক্তি বেদুঈন (যাযাবর)
জীবনে ফিরে যায় তারা সকলেই কিয়ামতের দিন মুহাম্মাদু -এর জবানীতে অভিশপ্ত মালউন।”
(আহমদ, আল-মুসনাদ ১/৪০৯, ৪৩০, ৪৬৪)
যারা যাকাত না দিয়ে সম্পদ জমা করে রাখে তাদের বিষয়ে আল্লাহ বলেন:
আল্লাহ্ তায়ালা নিজের অনুগ্রহ দিয়ে তাদের যে প্রাচুর্য দিয়েছেন যারা তা আল্লাহ্র পথে ব্যয় করতে কার্পণ্য করো তারা যেন কখনো এটা মনে না করে, এটা তাদের জন্যে কোনো কল্যাণকর কিছু হবে; না, এ কৃপণতা (আসলে) তাদের জন্যে খুবই অকল্যাণকর। কার্পণ্য করে তারা যা জমা করেছে, অচিরেই কিয়ামতের দিন তা দিয়ে তাদের গলায় বেড়ি পরিয়ে দেয়া হবে, আসমানসমুহ ও যমীনের উত্তরাধিকার তো আল্লাহ্ তায়ালার জন্যেই, আর তোমাদের প্রতিটি কার্যকলাপ সম্পর্কে আল্লাহ্ তায়ালা বিশেষভাবে অবগত রয়েছেন।
(সূরা,৩-আলে-ইমরান: আয়াত,১৮০)
সুতরাং যাদের ওপর যাকাত প্রদান ফরজ তারা সচেতন ও সতর্কতার সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে তা আদায় করুন।
মূলত পাঁচ প্রকার সম্পদের যাকাত প্রদান করা ফরয। (১) বিচরণশীল উট, গরু,
ছাগল ইত্যাদি গৃহপালিত পশু, (২) সােনা-রূপা, (৩) নগদ টাকা, (৪) ব্যবসা বা বিক্রয়ের জন্য রক্ষিত
দ্রব্য ও (৫) কৃষি উৎপাদন বা ফল ও ফসল। যেহেতু আমাদের দেশে খােলা চারণভূমিতে পশু পালনের
ব্যবস্থা নেই এবং নিসাবযােগ্য পশুও কারাে থাকে না, সেহেতু আমাদের দেশে গৃহপালিত পশুর যাকাত
সাধারণভাবে কাউকে দিতে হয় না। এছাড়া বাকি সম্পদগুলির যাকাত প্রদানের নিয়ম নিম্নরূপ:
(১) স্বর্ণ: যদি কারাে নিকট সাড়ে ৭ তােলা (ভরি) বা তার বেশি স্বর্ণ থাকে তবে প্রতি চান্দ্র
বৎসর (৩৫৪ দিন) পূর্তিতে মােট স্বর্ণের ২.৫% যাকাত প্রদান করতে হবে। যেমন কারাে যদি ১০ ভরি
স্বর্ণ থাকে তবে প্রতি বৎসরে তাকে ০.২৫ ভরি স্বর্ণ বা তার দাম যাকাত হিসাবে প্রদান করতে হবে।
সাড়ে ৭ ভরির কম স্বর্ণ থাকলে যাকাত ফরয হবে না।
(২) রৌপ্য: যদি কারাে কাছে সাড়ে ৫২ তােলা বা তার বেশি রূপা থাকে তবে প্রতি চান্দ্র বৎসরে
মােট রূপার ২.৫% যাকাত প্রদান করতে হবে।
(৩) নগদ টাকা। নগদ টাকার নিসাব হবে স্বর্ণ বা রৌপ্যের নিসাবে। হাদীসে মূলত রৌপ্যের
নিসাবই বলা হয়েছে। এছাড়া রূপার নিসাবে আগে যাকাত ফরয হয়। এজন্য বর্তমানে কারাে কাছে যদি
সাড়ে ৫২ তােলা রূপার দাম (২০০৮ সালের বাজার মূল্য অনুসারে: ২৪/২৫ হাজার টাকা) এক বৎসর
সঞ্চিত থাকে তবে তাকে মােট টাকার ২.৫% যাকাত দিতে হবে। যেমন কারাে যদি ৩০ হাজার টাকা
সঞ্চিত থাকে তবে তাকে বছর শেষে ৬৫০ টাকা যাকাত দিতে হবে।
(৪) ব্যবসায়ের সম্পদ। বিক্রয়ের জন্য রক্ষিত সকল সম্পদের যাকাত দিতে হবে। যদি
দোকানে, গােডাউনে, বাড়িতে মাঠে বা যে কোনাে স্থানে বিক্রয়ের জন্য রক্ষিত মাটি, বালি, ইট, গাড়ী,
জমি, বাড়ি, ফ্লাট বা অন্য যে কোনাে পণ্য থাকে এবং তার মূল্য সাড়ে ৫২ তােলা রূপার মূল্যের সমান
বা তার চেয়ে বেশি হয় তবে বৎসর শেষে মােট সম্পদের মূল্যের ২.৫% যাকাত দিতে হবে।
(৫) ভূমিজাত ফল ও ফসল। ফল-ফসলের যাকাতকে “উশর বলা হয়। ভুমি ব্যবহার করে
উৎপাদিত সকল প্রকারের ফল, ফসল, মধু, লবন ইত্যাদির যাকাত দিতে হবে। ফল-ফসলের যাকাত
দিতে হয় প্রতি মৌসূমে ফল-ফসল ঘরে উঠালে। হাদীস শরীফে ফল ফসলের নিসাব বলা হয়েছে ৫
ওয়াসাক। অর্থাৎ প্রায় ২৫ মণ। তবে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) বলেছেন যে, কম বেশি সব ফল-
ফসলেরই যাকাত দেওয়া দরকার। ফল-ফসলের যাকাতের পরিমাণ হলে ৫% বা ১০%। বৃষ্টির পানিতে
বা স্বাভাবিক মাটির রসে যে সকল ফসল বা ফল হয় তা থেকে ১০% যাকাত দিতে হবে। আর সেচের
মাধ্যমে উৎপাদিত ফল-ফসলের ৫% যাকাত দিতে হবে। ফল বা ফসলের মূল্যও প্রদান করা যায়।
টাকা-পয়সার যাকাত অনেকে প্রদান করেন, কিন্তু ফল-ফসলের যাকাত আমরা প্রদান করি
না। ফল-ফসলের যাকাত যে ফরয এ কথাটিই অনেক দীনদার মুসলমান জানেন না। কেউ চিন্তা করেন,
এত উৎপাদন ব্যয়, ট্যাক্স, খাজনা ইত্যাদি দেওয়ার পরে আর কিভাবে যাকাত দেব? এরূপ চিন্তা করলে তাে
আর ব্যবসায়ের যাকাতও দেওয়া লাগে না। সরকারের ট্যাক্স, ভ্যাট, দোকানের ভাড়া, সন্ত্রাসীদের চাঁদা
ইত্যাদির কারণে কি আল্লাহর ফরয যাকাত মাফ হয়? কেউ মনে করেন, ইসলামী রাষ্ট্র নয়, কাজেই ফসলের
যাকাত লাগবে না। আমাদের দেশ ইসলামী রাষ্ট্র কি না তা অন্য প্রশ্ন। তবে ইসলামী রাষ্ট্র না হলেই যদি
ফসরের যাকাত হয় তাহলে টাকাপয়সার যাকাতও মাফ হওয়া দরকার। নামাযও মাফ হওয়া দরকার।
হাযেরীন, হানাফী ফকহীহণ বলেছেন যে, অনৈসলামিক দেশের জমি, যে জমি উশরীও নয় খারাজীও
নয়, সে জমির উৎপাদনের উশর বা যাকাত দেওয়া ফরয। ইসলামী রাষ্ট্রে খারাজী জমির শরীয়ত নির্ধারিত
খারাজ দিলে যাকাত মাফ হতে পারে। খারাজ হলাে উশরের দ্বিগুণ রাষ্ট্রীয় ট্যাক্স, মূলত যাকাতের পরিবর্তে
কাফিরদের জমি থেকে ইসলামী রাষ্ট্র তা গ্রহণ করে। কিন্তু যে দেশ ইসলামী রাষ্ট্র নয় তথাকার কোনাে জমি
খারাজী হতে পারে না এবং এরুপ দেশের জমির উৎপাদনের উশর বা যাকাত মুসলিমকে দিতেই হবে।
যাকাত প্রদানের খাত সমূহ :
আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেন,
(এসব) ‘সাদাকা’ (যাকাত) হচ্ছে ফকীর-মেসকীনদের জন্যে, এর (ব্যবস্থাপনায় কর্মরত) কর্মচারীদের জন্যে, যাদের অন্তকরণ (দ্বীনের প্রতি) অনুরাগী করা প্রয়োজন তাদের জন্যে, (কোনো ব্যক্তিকে) গোলামীর (বন্ধন) থেকে আযাদ করার জন্যে, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিদের (ঋণমুক্তির) জন্যে, আল্লাহ তায়ালার পথে (সংগ্রামী) ও মোসাফেরদের জন্যে (এ সাদাকার অর্থ ব্যয় করা যাবে); এটা আল্লাহ তায়ালার নির্ধারিত ফরয; নিসন্দেহে আল্লাহ তায়ালা (সব কিছু) জানেন এবং তিনিই হচ্ছেন বিজ্ঞ, কুশলী ৷ (আত-তওবা:আয়াত,৬০)
উক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা যাকাত প্রদানের ৮টি খাত উল্লেখ করেছেন। নিম্নে প্রত্যেকটি খাত আলাদাভাবে আলোচনা করা হল-
(১) ফকীর : নিঃসম্বল ভিক্ষাপ্রার্থী। যাকে আল্লাহ তা‘আলা যাকাতের ৮টি খাতের প্রথমেই উল্লেখ করেছেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রতিনিয়ত দারিদ্র্য থেকে আল্লাহর নিকটে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন।
তিনি বলেন, হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট কুফরী ও দারিদ্র্য থেকে আশ্রয় চাচ্ছি’।[1] অতএব ফকীর যাকাতের মাল পাওয়ার হকদার। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
তোমরা যদি প্রকাশ্যে ছাদাক্বাহ প্রদান কর তবে উহা ভাল; আর যদি তা গোপনে কর এবং দরিদ্রদেরকে দাও তা তোমাদের জন্য আরো ভাল’ (বাক্বারাহ ২/২৭১)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
(২) মিসকীন : যাকাত প্রদানের ৮টি খাতের মধ্যে দ্বিতীয় খাত হিসাবে আল্লাহ তা‘আলা মিসকীনকে উল্লেখ করেছেন। আর মিসকীন হল ঐ ব্যক্তি যে নিজের প্রয়োজন মিটাতেও পারে না, মুখ ফুটে চাইতেও পারে না। বাহ্যিকভাবে তাকে সচ্ছল বলেই মনে হয়। হাদীছে এসেছে,
আবু হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, এমন ব্যক্তি মিসকীন নয় যে এক মুঠো-দু’মুঠো খাবারের জন্য বা দুই একটি খেজুরের জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ায় এবং তাকে তা দেওয়া হলে ফিরে আসে। বরং প্রকৃত মিসকীন হল সেই ব্যক্তি যার প্রয়োজন পূরণ করার মত যথেষ্ট সঙ্গতী নেই। অথচ তাকে চেনাও যায় না যাতে লোকে তাকে ছাদাক্বাহ্ করতে পারে এবং সে নিজেও মানুষের নিকট কিছু চায় না।[3]
(৩) যাকাত আদায়কারী ও হেফাযতকারী : আল্লাহ তা‘আলা যাকাত প্রদানের তৃতীয় খাত হিসাবে ঐ ব্যক্তিকে উল্লেখ করেছেন, যে ব্যক্তি যাকাত আদায়, হেফাযত ও বণ্টনের কাজে নিয়োজিত। অতএব উক্ত ব্যক্তি সম্পদশালী হলেও সে চাইলে যাকাতের অংশ গ্রহণ করতে পারবে।[4]
হাদীছে এসেছে,
ইবনু সায়ে‘দী আল-মালেকী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) আমাকে যাকাত আদায়কারী হিসাবে নিযুক্ত করলেন। যখন আমি কাজ শেষ করলাম এবং তাঁর কাছে পৌঁছিয়ে দিলাম তখন তিনি নির্দেশ দিলেন আমাকে পারিশ্রমিক দেওয়ার জন্য। আমি বললাম, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই আমি ইহা করেছি। সুতরাং আমি আল্লাহর নিকট থেকেই এর প্রতিদান নেব। তিনি বললেন, আমি যা দিচ্ছি তা নিয়ে নাও। কেননা আমিও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সময় যাকাত আদায়কারীর কাজ করেছি। তখন তিনিও আমাকে পারিশ্রমিক প্রদানের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তখন আমিও তোমার মত এরূপ কথা বলেছিলাম। রাসূল (ছাঃ) আমাকে বলেছিলেন, যখন তুমি না চাওয়া সত্ত্বেও তোমাকে কিছু দেওয়া হয়, তখন তুমি তা গ্রহণ কর। তুমি তা নিজে খাও অথবা ছাদাক্বাহ্ কর।[5]
অন্য হাদিসে এসেছে
আতা ইবনু ইয়াসার (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, সম্পদশালী ব্যক্তির জন্য যাকাত গ্রহণ হালাল নয়। তবে পাঁচ শ্রেণীর ধনীর জন্য তা জায়েয। (১) আল্লাহর পথে জিহাদরত ব্যক্তি। (২) যাকাত আদায়ে নিয়োজিত কর্মচারী। (৩) ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি। (৪) যে ব্যক্তি যাকাতের মাল নিজ মাল দ্বারা ক্রয় করেছে এবং (৫) মিসকীন প্রতিবেশী তার প্রাপ্ত যাকাত থেকে ধনী ব্যক্তিকে উপঢৌকন দিয়েছে।[6]
(৪) ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য কোন অমুসলিমকে যাকাত প্রদান করা : ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে অথবা কোন অনিষ্ট বা কাফেরের ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার লক্ষ্যে কোন অমুসলিমকে যাকাতের অর্থ প্রদান করা যায়।
(৫) দাস মুক্তির জন্য : যারা লিখিত কোন চুক্তির বিনিময়ে দাসে পরিণত হয়েছে। তাদেরকে মালিকের নিকট থেকে ক্রয়ের মাধ্যমে মুক্ত করার লক্ষ্যে যাকাতের অর্থ প্রদান করা যায়। অনুরূপভাবে বর্তমানে কোন মুসলিম ব্যক্তি অমুসলিমদের হাতে বন্দি হলে সে ব্যক্তিও এই খাতের অন্তর্ভুক্ত হবে।
হাদীছে এসেছে,
বারা ইবনু আযেব (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট এসে বলল, আমাকে এমন একটি আমল বলে দিন যা আমাকে জান্নাতের নিকটবর্তী করবে এবং জাহান্নাম থেকে দূরে রাখবে। রাসূল (ছাঃ) বললেন, প্রশ্ন তো তুমি অল্প কথায় বলে ফেললে; কিন্তু তুমি অত্যন্ত ব্যাপক বিষয় জানতে চেয়েছ। তুমি একটি প্রাণী আযাদ করে দাও এবং একটি দাস মুক্ত করে দাও। লোকটি বলল, এ উভয়টি কি একই কাজ নয়? তিনি বললেন, না (উভয়টি এক নয়)। কেননা একটি প্রাণী আযাদ করার মানে হল, তুমি একাকী গোটা প্রাণীকে মুক্ত করে দিবে। আর একটি দাস মুক্ত করার অর্থ হল, তার মুক্তির জন্য কিছু মূল্য প্রাদানের মাধ্যমে সাহায্য করবে। (এদ্ভিন্ন জান্নাতে প্রবেশকারী কাজের মধ্যে অন্যতম হল) প্রচুর দুধ প্রদানকারী জানোয়ার দান করা এবং এমন নিকটতম আত্নীয়ের প্রতি অনুগ্রহ করা, যে তোমার উপর অত্যাচারী। যদি তুমি এ সমস্ত কাজ করতে সক্ষম না হও, ক্ষুদার্থকে খাদ্য দান কর এবং পিপাসিতকে পানি পান করাও। সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজ হতে নিষেধ কর। আর যদি তোমার দ্বারা এ কাজ করাও সম্ভব না হয়, তবে কল্যাণকর কথা ব্যতীত অন্য কথা থেকে তোমার জিহবাকে সংযত রাখ।[10]
উল্লিখিত হাদীছে ইসলাম দাসমুক্তিকে জান্নাত লাভের বিশেষ মাধ্যম হিসাবে উল্লেখ করেছে। আর দাসমুক্তির জন্য যেহেতু প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়, সেহেতু আল্লাহ তা‘আলা ইসলামী অর্থনীতির প্রধান উৎস যাকাত বণ্টনের খাত সমূহের মধ্যে দাসমুক্তিকে উল্লেখ করেছেন।
(৬) ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি : ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে তার ঋণ থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে যাকাত প্রদান করা যাবে। হাদীছে এসেছে,
কাবীছা ইবনু মাখারেক (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার আমি কিছু ঋণের যিম্মাদার হয়েছিলাম। অতএব এ ব্যাপারে কিছু চাওয়ার জন্য আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট গেলাম। তিনি আমাকে বললেন, (মদ্বীনায়) আবস্থান কর যতক্ষণ পর্যন্ত আমার নিকট যাকাতের মাল না আসে। তখন আমি তা হতে তোমাকে কিছু দেওয়ার নির্দেশ দান করব। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) বললেন, মনে রেখ হে কাবীছা! তিন ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কারো জন্য (যাকাতের মাল হতে) সাহায্য চাওয়া হালাল নয়। (১) যে ব্যক্তি কোন ঋণের যিম্মাদার হয়েছে তার জন্য (যাকাতের মাল হতে) সাহায্য চাওয়া হালাল যতক্ষণ না সে তা পরিশোধ করে। তারপর তা বন্ধ করে দিবে। (২) যে ব্যক্তি কোন বালা মুছীবতে আক্রান্ত হয়েছে যাতে তার সম্পদ ধ্বংস হয়ে গেছে তার জন্য (যাকাতের মাল হতে) সাহায্য চাওয়া হালাল যতক্ষণ না তার প্রয়োজন পূর্ণ করার মত অথবা তিনি বলেছেন, বেঁচে থাকার মত কোন কিছু লাভ করে এবং (৩) যে ব্যক্তি অভাবগ্রস্ত হয়েছে এমনকি তার প্রতিবেশীদের মধ্যে জ্ঞান-বুদ্ধি সম্পন্ন তিন জন ব্যক্তি তার দারিদ্র্যের ব্যাপারে সাক্ষী প্রদান করেছে তার জন্য (যাকাতের মাল থেকে) সাহায্য চাওয়া হালাল যতক্ষণ না সে তার জীবিকা নির্বাহের মত অথবা তিনি বলেছেন, বেঁচে থাকার মত কিছু লাভ করে। হে কাবীছা! এরা ব্যতীত যারা (যাকাতের মাল থেকে) চায় তারা হারাম খাচ্ছে।[11]
(৭) আল্লাহর রাস্তায় : আল্লাহর দ্বীনকে সমুন্নত করার লক্ষ্যে যে কোন ধরনের প্রচেষ্টা ‘ফী সাবীলিল্লাহ’ বা আল্লাহর রাস্তার অন্তর্ভুক্ত। জিহাদ, দ্বীনী ইলম অর্জনের যাবতীয় পথ এবং দ্বীন প্রচারের যাবতীয় মাধ্যম এ খাতের অন্তর্ভুক্ত। হাদীছে এসেছে,
আতা ইবনু ইয়াসার (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, সম্পদশালী ব্যক্তির জন্য যাকাত গ্রহণ হালাল নয়। তবে পাঁচ শ্রেণীর ধনীর জন্য তা জায়েয। (১) আল্লাহর পথে জিহাদরত ব্যক্তি। (২) যাকাত আদায়ে নিয়োজিত কর্মচারী। (৩) ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি। (৪) যে ব্যক্তি যাকাতের মাল নিজ মাল দ্বারা ক্রয় করেছে এবং (৫) মিসকীন প্রতিবেশী তার প্রাপ্ত যাকাত থেকে ধনী ব্যক্তিকে উপঢৌকন দিয়েছে।[12]
(৮) মুসাফির : সফরে গিয়ে যার পাথেয় শেষ হয়ে গেছে সে ব্যক্তিকে যাকাতের অর্থ প্রদান করে বাড়ী পর্যন্ত পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে যাকাতের অর্থ দান করা যাবে। এক্ষেত্রে উক্ত মুসাফির সম্পদশালী হলেও তাকে যাকাত প্রদান করা যাবে।
2022-04-16 20:35:56
2022-04-16 20:35:56