ভারত তিস্তা চুক্তির চূড়ান্ত খসড়া পরিবর্তনের চেষ্টা করছে বলে মনে হয়: আইনুন নিশাত

বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে নানা ব্যখ্যা-বিশ্লেষণ চলছে। এটা অনেককে আতঙ্কিত করছে, খুশিও হচ্ছেন অনেকে। বন্যা নিয়ে এই অসঙ্গতির নানা দিক নিয়ে সাউথ এশিয়ান মনিটরের সঙ্গে কথা বলেছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত। সাক্ষাতকার নিয়েছেন শফিক রহমান।

স্যাম: উজানের পাহাড়ি ঢলের কারণে কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে নিয়মিত বন্যা হচ্ছে। কিন্তু এবারের বন্যাকে কোনভাবে আলাদা করা যায় কি?

আইনুন নিশাত: আমাদের দেশে পাহাড়ি ঢল হয় হাওড় অঞ্চলে- নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, সিলেট, হাবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারে। এটা হবেই, এটা স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক ব্যাপার। আমাদের চিন্তায় ফেলে বন্যা যদি এপ্রিল মাসে হয়, এমনকি মে মাসের মাঝামাঝি এলেও মহাবিপদ। কারণ ওই সময় বোরো ধান পাকে। কিন্তু জুলাই মাসে ঢল আসে আসুক। বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ পানিতে ঢুবে না গেলে আমরা বরং চিন্তিত হই, ভাবি এটা অস্বাভাবিক। তাই এ বছর অস্বাভাবিক কিছু দেখছি না। চলনবিল এলাকা ডুববে, আড়িয়াল বিল এলাকা ডুববে। মাদারীপুর, শরিয়তপুর, ফরিদপুরের বিল অঞ্চল ডুববে। এর মধ্যে পাহাড়ি ঢল পেলেন কোথায়?

দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশ একটি বিরাট দেশ। ম্যাপে ছোট হতে পারে কিন্তু কুড়িগ্রামের নদীর পানি যেভাবে আচরণ করে, আত্রাইর পানি সেই আচরণ করেনা। সুরমা, কুশিয়া কিংবা ওই দিককার নদীগুলো সেই আচরণ করেনা। উপকূলীয় এলাকার নদীগুলোও একই আচরণ করেনা। একইভাবে শহরের মধ্যের নদীগুলোও সমান আচরণ করেনা। এটা যদি ডিফাইন না করেন তাহলে আমাদের টকশোতে যে পণ্ডিতরা আছেন সব কিছু বুঝেন তারা অনেক কথা বলবেন।

চর যদি কোন জায়গায় ভাঙ্গে, বাঁধ যদি ভেঙ্গে কোন জায়গায় পানি ঢোকে সেটা অন্যায়। উপকূলীয় এলাকা বাঁধ আছে, সেটা টপকে কি পানি ঢুকেছে? ঢাকা শহরে কি বাঁধ উপচে পানি ঢুকেছে? পানি দেখলেই আপনি বন্যা বলবেন?

যেখানে পানি স্বাভাবিকভাবে ওঠার কথা উঠেছে। এখন থেকে যদি ৫০ বছর আগের তুলনা করেন তাহলে দেখা যাবে লোক সংখ্যা বাড়ছে। আগে যেখানে মানুষ থাকতো না এখন সেখানে মানুষ গেছে। নদী তার যে কাজ করার কথা সে তা করেছে। পানি উঠে এসেছে। পানিতো বেশি না। পানিতো অনেক নিচে। গত বছর আরো বড় বন্যা হয়েছে।

আমার মতে মানুষ এখন সবচেয়ে বিপদে আছে সাতক্ষিরা, খুলনা, বাগেরহাট ও বরগুনায়। একটু যান শ্যামগনর – দেখবেন বন্যা কাকে বলে। আমাবস্যা-পূর্ণিমার দিন বুক সমান পানি ঠেলে মানুষ চলাফেরা করে। যাদের উচু বাড়ি আছে তারা বাড়িতে থাকে, বাকি সবাই ত্রাণকেন্দ্রে অথবা বাঁধের ওপর বসে আছে। খাবার নেই, কাজ নেই, খাবার পানি নেই।

আর সবচেয়ে বিপদে আছে এখন আত্রাই। পানি নামতে পারছেনা কারণ যমুনার পানি বিপদসীমার কাছাকাছি। বিপদসীমার মানেইতো বোঝেন না বড় বড় সাহেবরা।

আপনি কি জানেন যমুনার চরের বাঁধ ভাঙলে সিরাজগঞ্জে মিলাদ পরানো হয়? কারণ, ঠিকাদাররা প্রচুর কাজ পাবেন এবং কাজ শুরু করবেন জুন মাসে, জুলাই মাসে যখন সব ভেঙ্গে চলে যাবে তখন বলবে ৮০ শতাংশ কাজ করেছিলাম সব ভেসে গেছে। আরো মজার বিষয় আছে, পানি উন্নয়ন বোর্ডে খোঁজ নেন, কোন জায়গায় পোস্টিংয়ের দাম বেশি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সুনামগঞ্জ অত্যন্ত দামি।

আগে ছিল সব ইঞ্জিনিয়ার সাহেবদের দখলে। তারপর সরকার আইন করলো প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য মনিটরিং কমিটি হবে সেখানে তিন জনের নামে দেবে এলাকার সংসদ সদস্য। ২০১৭ সালে বাঁধ ভেঙ্গে সুনামগঞ্জে বন্যা হয়েছে এর জন্য একটা লোক দায়ী। লোকটাকে আগে খুব শ্রদ্ধা করতাম তিনি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। মনিটরিং কমিটির জন্য যে নাম দেয়ার কথা অক্টোবর মাসে তিনি দরকষাকষি করে নাম দিয়েছেন পরের বছরের ফেব্রুয়ারির শেষে। তো কাজ শুরু হতে হতে মে মাস চলে এসেছে।

কে বা কারা হঠাৎ করে বললো এবারের বন্যা দির্ঘস্থায়ী হবে। দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে তো কি হয়েছে? আগে কৃষক আমন ধান লাগাতো। জুলাইয়ে কিংবা আগস্টে সেটা নষ্ট হয়ে গেলে দুর্ভিক্ষ হতো। এখনতো ৮০ শতাংশ জায়গায় বাঁধ আছে। বাঁধগুলো টিকিয়ে রাখতে পারলে সমস্যা নেই। বাঁধ নেই শেরপুর, জামালপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ, ঝালকাঠি, এই এলাকাগুলোতে। ওখানকার লোকেরতো মাথাব্যাথা নেই।

আমার এক ছাত্র এখন বুয়েটের শিক্ষক, আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি, তুমি এটা কিসের ভিত্তিতে বলেছো। সে বললো, ইউরোপিয়ান একটা ওয়েদার সেন্টার আছে তারা এ ফোরকাস্ট করেছে। সবারইতো ধান্দাবাজি আছে।

স্যাম: পানিবন্দি হওয়ার কারণে দুর্ভোগ বাড়ছে এটাতো সত্য?

আইনুন নিশাত: যারা কষ্ট পাচ্ছেন আমি তাদের প্রতি পূর্ণ সহানুভীতিশীল। দেখেন ব্রহ্মপুত্রের ডান পারে সিরাজগঞ্জ থেকে চৌহালি, কাজীপুর ইত্যাদি এলাকায় বাঁধ ছিল নদী থেকে এক কিলোমিটার বা আধা কিলোমিটার ভেতরে। এর মাঝে কোন মানুষ ছিলনা। এখন সেখানে জনবসতি হয়েছে, ছোট ছোট ফ্যাক্টরি হয়েছে, তাঁত বসেছে, ‍পাকা ঘর হয়েছে, বিভিন্ন ধরনের ইন্ডাস্ট্রি বসেছে। কিন্তু পানিতো উঠবেই।

ফলে সময় এসেছে কোথায় দুর্গতি, কেন দুর্গতি, কেন পানি উঠেছে সেগুলো দেখার এবং পানিটা ওঠা যদি স্বাভাবিক হয় তাহলে জোনিং করে চিহ্নিত করে বলে দেন- এখানে পানি উঠবেই।

স্যাম: বন্যা ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের দুর্বলতাগুলো কি কি?

আইনুন নিশাত: আমরা পুরো বাংলাদেশকে একটি ইউনিট বানিয়ে কথা বলি। যমুনার চরে আরও ১৫-২০ দিন পানি থাকবে। পদ্মার চর মানে রাজশাহীর পদ্মার কথা বলছি, মাওয়ার পদ্মার কেস আলাদা, মাওয়ার পদ্মাতে খুব বেশি বাড়ি ঘর নেই। কাঠালবাড়ির উল্টোদিকে যে চর জানাজা এইটার স্থায়িত্ব আর মাত্র ৫/৬ বছর। এর মধ্যে এটি বিলীন হয়ে যাবে। সেখানে দোতলা-চারতলা বাড়ি বানিয়েছেন কেন? কাজেই বাঁধ যেখানে আছে সেখানে ওয়ার্ক করতে হবে। আর নদী ভাঙ্গন হবেই। তাহলে আপনাকে নদী শাসন করতে হবে। ড্রেজিং করলে কিছু হবে না। যতবার ড্রেজ করবেন ততোবার ভরাট হয়ে যাবে যদিনা নদীর পলি পরিবহন ক্ষমতা বাড়ান। ফলে ট্যাকনিকাল সমস্যায় যদি প্রশাসনিক সমাধান দেয়া হয় তাহলে কি করে হবে। আমাদের এখানে জবাবদিহিতা নেই। টাকা দেবে গৌরি সেন, সরকার বরাদ্ধ করছে, কিছু লোক লুটে পুটে খাচ্ছে।

স্যাম: প্রতিবছরই বন্যার সম্মুখীন হতে হয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের করনীয় কি?

আইনুন নিশাত: করনীয় হচ্ছে ১৯৬৪ সালে মাস্টার প্লান হয়েছে, পরে ১৯৮৬, ১৯৯২ এবং ২০০২ সালে মাস্টার প্লান হয়েছে সেগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। স্থান-কাল-পাত্রভিত্তিক সমাধানের পথ বের করতে হবে। পানি ব্যবস্থাপনাকে, বন্যা ব্যবস্থাপনাকে, খরা ব্যবস্থাপনাকে নতুন করে সাজাতে হবে।

স্যাম: বাংলাদেশে বন্যার ঐতিহাসিক সংযোগটা কি? আগেও কি ঝুঁকি এবং ক্ষতি একই ছিল?

আইনুন নিশাত: ছিলনা, ১৯৪৭ সালে লোকসংখ্যা ছিল ৪ কোটি, এখন ১৮ থেকে ২০ কোটি। যেখানে মানুষের থাকার কথা নয় এখন সেখানেও মানুষ আছে। প্লাবন ভূমিতে মানুষ বসবাস করে। যেহেতু ভূমির ব্যবহার পদ্ধতি বদলে গেছে, পানি ব্যবস্থাপনাকে, বন্যা ব্যবস্থাপনাকেও সেভাবে নতুন করে ভাবতে হবে, নতুন করে চিন্তা করতে হবে।

স্যাম: ফারাক্কা বাঁধের কারণে আমাদের এই অঞ্চলের নদীতে কি প্রভাব পড়েছে?

আইনুন নিশাত: শীতকালের ফরমুলা গ্রীষ্মকাল বা বর্ষাকালে আনলে চলবে না। ফারাক্কা অক্টোবর মাস থেকে গেট বন্ধ করা শুরু করবে। পানি প্রবাহ বন্ধ করা শুরু করবে। এখনতো খোলা। মে-জুন-জুলাই-আগস্ট-সেপ্টেম্বর এই পাঁচ মাস ফারাক্কার নিচের অংশের নদীর আচরণ এক রকম। বাকি ৭ মাস তারা গেট বন্ধ করে উজানে পানি ধরে রাখে। ফলে একটা হচ্ছে শুকনাকালের সমস্যা, আরেকটা হচ্ছে বর্ষাকালের সমস্যা।

স্যাম: তিস্তা চুক্তির ভবিষ্যৎ কি?

আইনুন নিশাত: এটা রাজনৈতিক ব্যাপার। তিস্তা চুক্তিতো সচিব পর্যায়ে ইনিশিয়াল হয়ে আছে। মানে মন্ত্রীরা যাতে সই করবেন সেটার খসড়া চূড়ান্ত হয়ে আছে। এখন মনে হচ্ছে ভারত ওই খসড়াটা পরিবর্তনের চেষ্টা করছে। আর কবে সই হবে সেটা রাজনৈতিক ব্যাপার। এটা কারিগরি ব্যাপার নয়।

স্যাম: সাইন্টিফিক রিসার্চ জার্নাল বলছে, বাংলাদেশ বন্যার একটি অন্যতম হটস্পট। তাই দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের কি ধরনের পরিকল্পনা থাকা উচিত?

আইনুন নিশাত: এখানে নেপাল ভারতের সঙ্গে কথা বলেনা। ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলে না। ভারত-বাংলাদেশ-নেপাল এক সঙ্গে কথা বলেনা। দ্বিতীয়ত, এই যে ঝুঁকির কথাগুলো যেটা বলা হচ্ছে তা এখনই হবে না। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি খারাপ হয়ে ১০০ বছর পরে হবে।

তারপরও পরিকল্পনা ‍ও প্রস্তুতি থাকা দরকার। সেটা আছেও। ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে যৌথ নদী কমিশন যখন সেটআপ করা হয় তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং মিসেস গান্ধী বন্যাকেই সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছেন। তার মানে ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশ এবং ভারত মনে করেছে বন্যা ব্যবস্থাপনায় যৌথভাবে কাজ করা উচিত। তো সেই বাহাত্তর সালের পরে ৫০ বছর পার হয়ে গেছে কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে দেখেন? পুরোটাই রাজনীতির ব্যাপার।

আবার ২০১১ সালে আবার চুক্তি হয়েছে অববাহিকাভিত্তিক ব্যাবস্থাপনা হবে। গত ৮ বছরে তার কোন লক্ষন দেখিনি।

2021-01-30 06:29:31

0000-00-00 00:00:00

Published
Categorized as 17

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *