ভারতের ত্রিপুরায় মসজিদ ও মুসলিমদের উপর হামলা

বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলার পর অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করছিলেন, এই হামলার জের ধরে ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিমদের উপর হামলার ঘটনা ঘটতে পারে। সাধারণত বিজেপি সরকারের বিভিন্ন নীতির কারণে দেশটিতে মুসলিম সম্প্রদায় চাপের মধ্যেই আছে দীর্ঘকাল। এর উপর বাংলাদেশে মুসলিমদের সাম্প্রদায়িক অবস্থান ভারতের পরিস্থিতিকে আরও উস্কে দেবে বলেই ধারণা করা হচ্ছিল। আর এই ধারণাই সত্যে রূপ নিল।
সম্প্রতিই বাংলাদেশের কুমিল্লার দূর্গামণ্ডপে কোরআন রাখাকে কেন্দ্র করে একাধিক দূর্গা মণ্ডপে উগ্রবাদীরা হামলা একের পর হিন্দু এলাকায় চলেছিল তাণ্ডব। এই অতর্কিত হামলায় প্রাণ হারিয়েছে বেশ কয়েকজন।আমেরিকা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপুঞ্জেও এই বর্বরচিত হামলার করা হয়েছে নিন্দা।
তবে এরই মধ্যে শোনা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাজ্য ত্রিপুরাতে এই হামলার আঁচ গিয়ে আছড়ে পড়েছে। গত শুক্রবার ত্রিপুরার জমিয়ত উলেমা-ই-হিন্দ সংগঠন অভিযোগ করে বলেছে যে, বাংলাদেশের ঘটনার পর রাজ্যে কিছু মসজিদও সংখ্যালঘুদের বাড়িতে হামলা চালানো হয়েছে। তারা রাজ্য সরকার ও মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বন্দোবস্ত নেওয়ার দাবি জানিয়েছে।
আগরতলার গেদু মিয়া মসজিদে সংগঠনের সভাপতি মুফতি তায়েবউর রহমান বলেন, ‘ত্রিপুরার হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের কেউ বাংলাদেশে এই ধরনের সহিংসতা সমর্থন করে না। আমরা এর প্রতিবাদও করেছি।’ তিনি বলেন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কিছু মসজিদ এবং আবাসিক এলাকায় হামলা হয়েছে। বেশিরভাগ হামলাই ত্রিপুরার পশ্চিম, উত্তর এবং গোমতি জেলায় হয়েছে।
ভারতের একটি পত্রিকার সূত্র মতে, গত ২০ অক্টোবর ভারতের ত্রিপুরায় মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হয়েছে। রাজ্যজুড়ে চলা এই হামলায় অন্তত ৬টি মসজিদ এবং এক ডজনেরও বেশি বাড়িঘর-দোকানপাট ভাঙচুর করা হয়েছে। জর্ডানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম মাকতুব মিডিয়ার বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে ভারতের তেলেঙ্গানা রাজ্যভিত্তিক দৈনিক দ্য সিয়াসাত ডেইলি।
ভারতের কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি), হিন্দু জাগরণ মঞ্চ, বজরং দল এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) ব্যানারধারী কিছু সদস্য এই হামলার সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে জানিয়েছে পত্রিকাটি।
ভারতের মুসলিম ছাত্রদের সংগঠন স্টুডেন্টস ইসলামিক অর্গানাইজেশনের (এসআইও) ত্রিপুরা রাজ্য শাখার কর্মী সফিকুর রহমান জানিয়েছেন, ২০ অক্টোবর রাতে একযোগে ত্রিপুরার গোমতি জেলার উদয় পুর ও রাজ্যেল কৃষ্ণনগর, ধর্মনগর, পানিসাগর ও চন্দ্রপুরের ৬ টি মসজিদে হামলা চালানো হয়। উদয়পুর ও পানিসাগরের মসজিদ হামলাকারীরা পুড়িয়ে দিয়েছে, বাকিগুলোতে ভাঙচুর চালানো হয়েছে। সবগুলো এলাকায় মিছিল করে হামলা চালানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন শফিকুর রহমান। তাদের পরণে ছিল গেরুয়া রঙের কাপড়।
সফিকুর রহমান আরও বলেন, ‘সম্প্রতি বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গাপূজায় হামলা হয়েছে। তার জের ধরেই ত্রিপুরায় হামলা চালিয়েছে হিন্দুত্ববাদী সংগঠগুলো।’
এ ঘটনায় ত্রিপুরার প্রশাসনসূত্রে জানা গেছে, রাজ্যের যেসব এলাকায় হামলা হয়েছে, সেসব স্থানে নিরাপত্তা রক্ষায় ইতোমধ্যে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে।
এই ঘটনা নিয়ে ত্রিপুরার বিজেপি মুখপাত্র নবেন্দু ভট্টাচার্য বলেন, ‘কিছু ঘটনার কথা কানে এসেছে। প্রশাসন এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে। আমরা কোনোভাবেই এমন ঘটনাকে প্রশ্রয় দিই না। কিছু মানুষ ইচ্ছে করে সরকারের দুর্নাম করতে এমন ঘটনা ঘটাচ্ছে। অভিযুক্তদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
অন্যদিকে, এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর সিপিএম সচিব জিতেন্দ্র চৌধুরী বলেন, আশা করব যে, রাজ্যের সরকার এমন ধরণের অপ্রীতিকর ঘটনা রুখতে যথাযথ পদক্ষেপ নেবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে কোথাও সাম্প্রদায়িক হামলা হলে ভারত সরকারের প্রতিক্রিয়ায় কারও মনে হতে পারে যে বাংলাদেশের নির্যাতিত হিন্দুদের পাশে দাঁড়াচ্ছে ভারতের সরকার, দূতাবাস। কিন্তু কার্যত তাদের ভূমিকা এ দেশে হিন্দু পরিচয়ের মানুষদের রীতিমতো অপমানিত করে, তাদের নিরাপত্তাহীনতাও বাড়ায়। এতে হিন্দু জনগোষ্ঠীর সমস্যার সমাধান তো হয়ই না, বরং এ দেশে যারা সারাক্ষণ দাবি করে ‘হিন্দুরা ভারতের লোক’, তাদের গলার জোর বাড়ে।
ভারতের বিশেষজ্ঞরাই বলেন, বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতন ভারতের বিজেপি সরকারের সে দেশে রাজনৈতিক ফায়দা ওঠাতে সাহায্য করে বলেই এ নিয়ে তাদের এত উৎসাহ। তার মানে, বাংলাদেশে যারা ইসলামের নামে মন্দির বা হিন্দুবাড়িতে হামলা করছে, তারা প্রকারান্তরে ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকেই সহায়তা করছে, ভারতের মুসলমানদের অবস্থা আরও নাজুক করছে। মূলত দুই দেশের রাজনীতিতে ধর্মীয় সুবিধা আদায়ের সংস্কৃতিই দেশ দুটিতে হিন্দু মুসলিমদের মধ্যে ভেদনীতির চিরায়ত এক ভীত গড়ে তুলেছে।
স্টেটওয়াচ/এসডব্লিউ/এসএস/১৫০৮

2022-04-09 16:39:50

2022-04-09 06:39:50

Published
Categorized as 27

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *