বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তি পরিবর্তনের চিন্তা ভাবনা করছে সরকার

সরকার দেশের শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য, আধুনিক বিশ্বের সাথে মিল রেখে পরিবর্তনের চিন্তা ভাবনা করতেই পারে। কিন্ত প্রশ্ন হচ্ছে পরিবর্তনের ভিত্তি, রূপরেখা এবং এই ব্যাপারে অভিজ্ঞ দল নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ দের মতামতের ভিত্তিতে না অন্য কারো বা পরিষ্কার করে বললে বলতে হয় অন্য কোন দেশের সাথে মিল রেখে তালমিলের মাধ্যম হচ্ছে কি না?

২০০৫ সালে সম্ভবত বিএনপি সরকার যখন মাধ্যমিক পর্যায়ে সায়েন্স-আর্টস-কমার্স বাদ দিয়ে একমুখী শিক্ষা প্রস্তাব করেছিল, জাফর ইকবাল স্যার তখন খুব রাগ করেছিলেন। তিনি পত্র-পত্রিকার পাতা কাঁপিয়ে যুক্তি তো দিয়েছিলেনই যে কেন এই একমুখী শিক্ষা বন্ধ করা দরকার, একই সঙ্গে আন্দোলনেও নেমেছিলেন যেন সরকার এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। স্যারের ভাষ্য অনুযায়ী একমুখী শিক্ষা মানে শুধু সায়েন্স-আর্টস-কমার্স এক করে দেয়া নয়, বরং ইংরেজি মাধ্যম, বাংলা মাধ্যম ও বিপুল পরিমাণ মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের একসাথে একই সিলেবাস পড়ানোর নামই একমুখী শিক্ষা। একই সঙ্গে স্যার আরও বলেছিলেন যে, সরকার যেই পাঠ্যক্রম প্রস্তাব করেছে সেখানে ১০০ নম্বরের ধর্মশিক্ষা আছে, ১০০ নম্বরের ব্যাবসায় শিক্ষা আছে, কিন্তু ফিজিক্স আর কেমিস্ট্রির জন্য বরাদ্দ আছে কেবল ৩৭.৫ নম্বর করে। অর্থাৎ ছাত্র-ছাত্রীরা যতটুকু পদার্থবিজ্ঞান (কিংবা রসায়ন) শিখবে তার থেকে তিনগুণ তাদের ধর্ম কিংবা ব্যবসায় শিক্ষা শিখতে হবে। স্যার আরও বলেছিলেন শিক্ষকের হাতে যদি তিরিশ নম্বর থাকে তাহলে সেটা কখনোই ন্যায়সঙ্গতভাবে দেয়া হবে না।

যা হোক, স্যারের তীব্র আন্দোলনের মুখেই হোক, স্যারের বিশেষজ্ঞ মতামতকে সম্মান জানিয়েই হোক, বা যে কোন কারণেই হোক, তৎকালীন বিএনপি-জামাত সরকার এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে।

পনের বছর পর, ২০২০ খ্রিস্টাব্দে একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। মাধ্যমিকে থাকছে না সায়েন্স-আর্টস-কমার্স, সবাইকে একই বিষয় পড়তে হবে। এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান নামে একটি বিষয় থাকবে, তবে সেখানে ফিজিক্স বা কেমিস্ট্রি আদৌ ৩৭.৫ করে থাকবে না তার চেয়েও কমে যাবে সেটা স্পষ্ট নয় এখনও। এসএসসিতে দশটি বিষয়ের মাঝে পাঁচটি বিষয়ের পরীক্ষা হবে পাবলিকলি, আর পাঁচটি বিষয়ের মার্কস (অর্থ্যাৎ পুরো পরীক্ষার ৫০% মার্কস) আসবে স্কুল থেকে, অর্থ্যৎ স্কুলের শিক্ষকদের হাতেই থাকবে ৫০% মার্কস। এই সিলেবাসে ‘ভাল থাকা’ নামে বিষয় আছে, তবে কৃষিশিক্ষা নেই।

জাফর ইকবাল স্যার এই শিক্ষানীতি নিয়ে তেমন আপত্তি করেননি, বরং খুঁজে দেখলাম এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে যখন এই নীতি পর্যালোচনা হচ্ছিল, তখন তিনি এটাকে স্বাগত জানিয়ে কলাম লিখেছিলেন। সেই কলামে তিনি বলেছেন যে – মাধ্যমিকে যার টাকা আছে, যে প্রাইভেট পড়তে পারবে, সে বিজ্ঞান বিভাগে পড়বে আর যার টাকা নেই প্রাইভেট পড়ার ক্ষমতা নেই তাকে মানবিক বা ব্যবসায় শিক্ষা পড়তে হবে – এটা কেমন কথা? কাজেই মাধ্যমিকে আলাদা বিভাগ থাকার প্রয়োজনই নেই। বরং সবারই কিছু বিজ্ঞান সঙ্গে কিছু অর্থনীতি পড়া ভাল।

স্যারের কাছে বিনীত অনুরোধ এই যে, আমাকে দয়া করে এই কয়েকটা পয়েন্ট একটু বুঝিয়ে বলুন।

১। আগে স্কুলের শিক্ষকের হাতে তিরিশ নম্বর ছিল, যেটার মিসইউজ হবে বলে আপনি রাজী হননি। এখন স্কুলের শিক্ষকদের হাতে ৫০% নম্বর চলে যাচ্ছে, এটার মিসইউজ হবে না আপনি কীভাবে নিশ্চিত হলেন?

২। ২০০৫ এ ১০০ নম্বরের ধর্মশিক্ষা ছিল আর এক বিজ্ঞান বিষয়ের মাঝে ফিজিক্স-কেমিস্ট্রি ৩৭.৫ করে ছিল। এখনও ১০০ নম্বরের ধর্মশিক্ষা থাকছে, সাথে একই বিজ্ঞান বিষয়ের মাঝে ফিজিক্স-কেমিস্ট্রি এবং সম্ভবত বায়োলজিও থাকছে। তাহলে ফিজিক্স-কেমিস্ট্রির মার্কস থাকছে ৩৩.৩ করে। আপনার যদি কেবলমাত্র ৩৭.৫ নম্বরের ফিজিক্স কেমিস্ট্রি পড়া নিয়ে আপত্তি থেকে থাকে, এখন ৩৩.৩ নম্বরের ফিজিক্স কেমিস্ট্রি পড়া নিয়ে আপত্তি নেই কেন?

৩। ১০০ নম্বরের ব্যবসায় শিক্ষা পড়তে দিতে আপনি রাজী হননি, বলেছিলেন বিজ্ঞান কম পড়ে ব্যবসায় শিক্ষা পড়ার কী দরকার? আমি একমত আপনার সঙ্গে। কিন্তু এখন যে ব্যবসায় শিক্ষাও নেই, এর বদলে আছে ১০০ নম্বরের ‘ভাল থাকা’। এটাকে আপনি কেন জরুরী মনে করেন ব্যবসায় শিক্ষার চেয়েও?

৪। অর্থনীতি তো নতুন শিক্ষাক্রমে নাই-ই, কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে কৃষিশিক্ষাও নাই। আপনি কি সন্তুষ্ট?

৫। ২০০৫ এর তথাকথিত একমুখী শিক্ষার সঙ্গে আজকের এই নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠ্যক্রমগত কী পার্থক্য আছে?

প্রশ্নগুলো সহজ স্যার, আর উত্তরও তো জানা। তবু আপনি বললে ভাল হয়, না বললেও ক্ষতি নাই। আশা করব দেশের ভবিষ্যতের প্রজন্মের ভালো চিন্তা ভাবনার থেকে সন্মানিত শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বুদ্ধিজীবীদের বিশেষ নজর থাকবে বিষয়ের উপর। অন্ধ দলীয় আনুগত্য মোতাবেক অন্ধ সেজে চোখ কান বুঝে থাকলে বাংলাদেশের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে এবং এক সময় আসবে অবশ্যই কৈফিয়ত দিতে হবে। পৃথিবীর পরিস্থিতি চির পরিবর্তনশীল এবং এক সময় পরিস্থিতির পরিবর্তন হবেই হয়ত তখন আর কিছুই করার থাকবে না।

মাসুদ শরফুদ্দীন
ঢাকা, বাংলাদেশ।

2021-01-30 06:29:31

0000-00-00 00:00:00

Published
Categorized as 17

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *