ভিসি অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের দাবিতে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা এবার গোলচত্বরকে ঘিরে রংতুলির আচড়ে প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠেছেন।
ভিসির পদত্যাগের দাবিতে বিভিন্ন স্লোগান এখন শিক্ষার্থীদের মুখে মুখে। এসব স্লোগান এখন রংতুলির ছোঁয়ায় ফুটে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলচত্বরে।
সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলচত্বরে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে ‘পতন পতন পতন চাই, স্বৈরাচারের পতন চাই’, ‘যেই ভিসি মিথ্যা বলে, সেই ভিসি চাই না’, ‘যেই ভিসি বোমা মারে, সেই ভিসি চাই না’, ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, শাবিপ্রবি মুক্তি পাক’ ইত্যাদি স্লোগান লেখা হয়েছে।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা জানান, ভিসির পদত্যাগের দাবিতে প্রতিবাদী এসব স্লোগান লেখা হয়েছে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা নিজেরাই এসব স্লোগান সড়কে ফুটিয়ে তুলেছেন।
এদিকে, রোববার ভিসির পদত্যাগের দাবিতে চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে সন্ধ্যা ৭টা ২০ মিনিটে ভিসির বাসভবনে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন করায় ভিসির বাসভবন, গেস্টহাউস, শিক্ষক ডরমেটরি অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।
এর আগে শাবিপ্রবিতে যা ঘটেছে-
১৩ জানুয়ারি, বৃহস্পতিবার
সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) আন্দোলনের সূত্রপাত এদিন রাতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিরাজুন্নেসা হলের ছাত্রীরা রাত সাড়ে ৯টার দিকে প্রভোস্ট জাফরিন লিজার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে, তিনি ছাত্রীদের সাথে অসদাচরণ করেন বলে ছাত্রীরা অভিযোগ করেন।
এর প্রতিবাদে রাত সাড়ে ১০টার দিকে ছাত্রীরা বিক্ষোভ শুরু করেন।
রাত সাড়ে ১১টার দিকে তারা ভিসি ফরিদ উদ্দিন আহমেদের বাসভবন চত্বরে অবস্থান নিয়ে স্লোগান দিতে থাকেন।
১৪ জানুয়ারি, শুক্রবার
ভিসির সাথে দুপুর ১২টা থেকে শুরু হওয়া প্রায় ঘন্টাব্যাপী বৈঠক শেষে তা ফলপ্রসূ হয়নি জানিয়ে কর্মসূচি চলমান রাখেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।
বিকাল ৪টার দিকে তারা নতুন প্রভোস্ট নিয়োগের জন্য শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়ে আন্দোলন স্থগিত করেন।
বিকেল পৌনে ৫টার দিকে ভিসি জানান, সিরাজুন্নেসা হলের সহকারী প্রভোস্ট যোবাইদা কনক খানকে ভারপ্রাপ্ত প্রভোস্ট হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
১৫ জানুয়ারি, শনিবার
বিকেল সাড়ে ৫টার দিক থেকে, প্রভোস্ট কমিটির পদত্যাগসহ অন্য দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় গোলচত্বরসংলগ্ন সড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা।
সন্ধ্যায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করা হয়। এই হামলায় ১০-১২ জন শিক্ষার্থী আহত হন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. আলমগীর কবীরের উপস্থিতিতে গোলচত্বরের পাশে কিলো রোডে ছাত্রলীগ এই হামলা করে বলে অভিযোগ করা হয়।
১৬ জানুয়ারি, রোববার
সকাল থেকেই শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলচত্বরসংলগ্ন প্রধান সড়ক অবরোধ করে সকল ধরনের গাড়ি প্রবেশে বাধা দেন।
বিকেলের দিকে ভিসি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি ভবনে গেলে সেখানে তাকে অবরুদ্ধ করেন শিক্ষার্থীরা।
ভিসিকে মুক্ত করতে বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে পুলিশ সেখানে গেলে, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশ ২১টি সাউন্ড গ্রেনেড ও ২৭ রাউন্ড শটগানের বুলেট ব্যবহার করে।
আন্দোলনের মুখে প্রভোস্ট জাফরিন লিজা পদত্যাগ করলে, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নাজিয়া চৌধুরীকে নতুন প্রভোস্ট নিয়োগ দেয়া হয়।
রাতে জরুরি সিন্ডিকেট সভা শেষে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। সোমবার দুপুর ১২টার মধ্যে হল ছাড়তে নির্দেশ দেয়া হয় শিক্ষার্থীদের।
১৭ জানুয়ারি, সোমবার
ভিসির কার্যালয় ও সব প্রশাসনিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
ভিসির পদত্যাগের দাবিতে বিকেলে তার বাসভবন ঘেরাও করে কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা।
আগের দিনের সংঘর্ষের ঘটনায়, আহত সকলের চিকিৎসার ব্যয় বিশ্ববিদ্যালয় বহন করবে বলে জানানো হয়।
একই ঘটনায় জালালাবাদ থানা পুলিশ অজ্ঞাতপরিচয় প্রায় ৩০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে।
১৮ জানুয়ারি, মঙ্গলবার
শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার করা না হলে, কঠোর আন্দোলনের হুমকি দেন শিক্ষার্থীরা। ভিসিকে পদত্যাগের জন্য বুধবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন তারা।
ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া একটি অডিও ক্লিপে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্য করতে শোনা যায় শাবিপ্রবির ভিসিকে। এমন মন্তব্যের ফলে অনেক ছাত্রীরই উচ্চশিক্ষার পথ বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন কোনো কোনো শিক্ষক।
১৯ জানুয়ারি, বুধবার
বিকেল ৩টায় ভিসির পদত্যাগ ও পুলিশের মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে আমরণ অনশন কর্মসূচি শুরু করেন শিক্ষার্থীরা।
২০ জানুয়ারি, বৃহস্পতিবার
অনশনরত শিক্ষার্থীদের একজন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন।
ভিসির ফাঁস হওয়া আপত্তিকর মন্তব্য ৭২ ঘন্টার মধ্যে প্রত্যাহার দাবি করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও ঢাকা জজ আদালতের এক আইনজীবী। তিনি ভিসিকে আইনি নোটিশ পাঠান। এ ছাড়া শাবিপ্রবির ভিসির মন্তব্যের প্রতিবাদ জানায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি।
২১ জানুয়ারি, শুক্রবার
দুপুর ৩টার দিকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। তিনি শিক্ষার্থীদের ঢাকায় গিয়ে আলোচনার আহ্বান জানালে, শিক্ষার্থীরা ভার্চ্যুয়ালি বৈঠক করার প্রস্তাব দেন। দীপু মনি বলেন, ‘সব সমস্যারই একটা সমাধান আছে। এই সমস্যারও নিশচয়ই সমাধান আছে। তবে আলোচনার মাধ্যমেই সেই সমাধান খুঁজে বের করতে হবে শিক্ষার্থীদের ৪-৫ জন যদি আসেন, শিক্ষক সমিতির নেতারা যদি আসেন, তবে আমরা আলাপ করে একটা সমাধানে পৌঁছতেও পারব।’
ক্যাম্পাসের দেয়ালে ‘নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি : ভিসি পদ ফাঁকা আছে’ লিখে দেন আন্দোলনকারীরা। অনশনের তৃতীয় দিনে ১২ জন শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন।
২২ জানুয়ারি, শনিবার
সন্ধ্যায় মন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে শাবিপ্রবির শিক্ষকদের একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করেন শিক্ষামন্ত্রী। বৈঠকে কোনো সিদ্ধান্ত না হলেও আলোচনা চলমান থাকবে বলে জানান মন্ত্রী। তিনি আবারো শিক্ষার্থীদের তার সঙ্গে আলোচনায় বসার জন্য আহ্বান জানান। দিনশেষে প্রায় মধ্যরাতের দিকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ঘোষণা দেন, শিক্ষামন্ত্রী তাদের সঙ্গে ভার্চ্যুয়ালি বৈঠক করবেন।
২৩ জানুয়ারি, রোববার
শনিবার দিবাগত রাত ১টার পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি ভবনের একটি কক্ষে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে ভার্চ্যুয়াল বৈঠক শুরু হয় শিক্ষার্থীদের।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৪ জন শিক্ষার্থী দাবি আদায়ে গত বুধবার বেলা ৩টার দিকে যে অনশন শুরু করেছিলেন তাদের মধ্যে ২৩ জন এখনো অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন। রোববার সকাল ১০টায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত আমরণ অনশনরত ২৩ শিক্ষার্থীর সঙ্গে নতুন করে যোগ দিয়েছেন আরো চারজন, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ১৬ জন।
2022-04-09 16:36:18
2022-04-09 06:36:18