নিজস্ব সংবাদদাতা: দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়েছেন দেশের বিশিষ্টজনরা। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ডাকা সংলাপে তারা এ শঙ্কা প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে ঐক্যমত ছাড়া ইভিএম ব্যবহার, নির্বাচনকালীন প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ইসির নিয়ন্ত্রণে আনাসহ বেশ কিছু পরামর্শও দিয়েছেন তারা।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় দফা সংলাপে এসব পরামর্শ দেন বিশিষ্টজনরা। এই সংলাপে ৩৯ বিশিষ্ট নাগরিককে আমন্ত্রণ জানানো হলেও অংশ নেন ১৯ জন।
সংলাপে অংশ নেওয়া কেউ কেউ অতীত অভিজ্ঞতার প্রসঙ্গ তুলে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন। আবার কেউ অসম্ভব না হলেও কঠিন বলে মত দিয়েছেন। সুষ্ঠু নির্বাচন করতে না পারলে পদত্যাগ করার মানসিকতা রাখার কথাও উঠে এসেছে সংলাপে।
তারা বলেছেন, ভোট ব্যবস্থাপনার প্রতি ভোটারদের আস্থা ফেরাতে হবে। সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিতে উদ্যোগী হতে হবে। সেইসঙ্গে কমিশনকে কাজ দিয়েই প্রমাণ করতে হবে, তারা নিরপেক্ষভাবে ভোট করবেন।
বিশিষ্টজনেরা জাতীয় নির্বাচনে সবার ঐকমত্য ছাড়া ইভিএম ব্যবহার না করা, ভোটারদের বাধাহীনভাবে ভোটদানের অধিকার নিশ্চিত করা, ভোটের আগে-পরে ভোটারদের বিশেষ করে নারী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, নির্বাচনকালীন প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে আনার পরামর্শ দিয়েছেন।
সংলাপে সিপিডির ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘ইভিএমের ব্যবহার অত্যন্ত বিতর্কিত বিষয়। এটা থেকে দূরে থাকা ভালো। ইভিএম ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও জটিল করে দিতে পারে। ঝুঁকি নিয়ে ইভিএম ব্যবহার করা উচিত নয়।’
তিনি বলেন, ‘নির্বাচন ব্যবস্থাপনার ওপর আস্থা ফিরিয়ে আনাই চ্যালেঞ্জ। নির্বাচনকালীন আইন-বিধির যথাযথ প্রয়োগ করতে পারেন কিনা তা দেখা যাবে। অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন করবেন। সাহসিতার সঙ্গে কাজ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন। প্রতিবন্ধকতা এলে পদত্যাগের সাহস রাখবেন।’
সিপিডির মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘ইভিএম ব্যবহার করলেই প্রশ্নবিদ্ধ হবেন। একটি ভালো ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দেবেন।’
লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ইভিএম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ যন্ত্রে যে ম্যানুপুলেট করা যায় না, তা নিশ্চিত না করে ব্যবহার করা যাবে না।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফরাস উদ্দিন বলেন, ‘ইভিএম সব সময় বিতর্কিত। এটার সমাধান না করে ব্যবহার করা ঠিক নয়। জোরের সঙ্গে বলবো, ইভিএম ব্যবহার না করার জন্যে।’
তিনি আরও বলেন, ভোটের আগে- পরে ছয় মাস নির্বাচনকালীন কর্তৃত্ব কমিশনের কাছে থাকা উচিত। ২০২৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে একাদশ সংসদের অধিবেশন থাকবে না। এ জন্যে ভোটের আগে চার মাস, ভোটের পরে দুই মাস-এ ছয় মাসের জন্য ক্ষমতা ইসির হাতে থাকতে পারে। আস্থা অর্জন করতে পারলে সবাইকে নিয়ে শান্তিপূর্ণ ভোট করা সম্ভব।
লিডারশিপ স্টাডিজ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. সিনহা এম এ সাঈদ, বলেন, ‘ইসি এত সংলাপ করার মানে হচ্ছে এখানে সংকট রয়েছে। আপনার কাজ দিয়ে প্রমাণ করুন, আস্থা অর্জন করুন সবার। নির্বাচনের সময় কতটুকু নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে পারেন সংশয় রয়েছে। আমি আশাবাদী মানুষ।’
নির্বাচনকালীন সরকারের চরিত্রের ধরণ, কেমন নির্বাচন হবে এ নিয়ে বিদ্যমান আইন বিধিতে কী ধরনের পরিবর্তন আনা যায় সে বিষয়ে কাজ পরার পরামর্শ দিয়েছেন টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
তিনি বলেন, ‘সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য আইনে কোনো পরিবর্তন করা যায় কিনা তা চিহ্নিত করেন আপনারা।’ সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দেন তিনি।
সরকারের অনুগত না থেকে রাষ্ট্রের জন্য কাজ করে যাওয়ার পরার্শ দিয়ে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘প্রয়োজনে ইস্তফা দেবেন। সব অংশীজন, ভোটার, আমরা আপনাদের পক্ষে আছি।’
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘ভোটাররা নির্বাচনবিমুখ হয়ে পড়েছে। ইসি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। অতীতের ভুলভান্তি স্বীকার করে কাজ এগিয়ে নিতে হবে।’
তিনি জানান, ক্ষমতায় থেকে নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব নয়। গত দুটি নির্বাচনে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন করার বিষয়টি সরকার প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।’
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ইভিএম’র বিরোধিতা করে বলেন, ‘বিনা টেন্ডারে কীভাবে ইভিএম এলো। ইভিএম নিয়ে একজনের এত উৎসাহ কেন, তা নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে। কোনোভাবে বড় পরিসরে ইভিএম ব্যবহার করা যাবে না। চাইলে ৫-১০ কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার করতে পারে। তবে এটা না হওয়াই ভালো।’
তিনি বলেন, সার্চ কমিটির কারণে বর্তমান কমিশন কিছুটা আস্থা সংকটে পড়েছে। সবার নাম প্রকাশ করেনি কমিটি। এছাড়া নূরুল হুদা কমিশনের সাবেক সচিব ও আরেক সাবেক সচিবের শ্বশুর আওয়ামী লীগ নেতা হওয়ায় নতুন ইসির দুই সদস্য নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
দুই-একজন ইভিএমের পক্ষে মত দিলেও ইভিএমের ভোটে পোলিং এজেন্ট না রাখার প্রস্তাব করেন তিনি।
ফেব্রুয়ারির শেষে দায়িত্ব নেয়ার পর এ নিয়ে দ্বিতীয় দফা সংলাপে বসে নতুন নির্বাচন কমিশন। প্রথম ধাপের মতো এবারও আমন্ত্রণ পাওয়া বেশির ভাগ বিশিষ্টজন কমিশনে আসেননি।
যারা সংলাপে অংশ নিয়েছেন তারা হলেন- ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, মোস্তাফিজুর রহমান, আলী ইমাম মজুমদার, আব্দুল লতিফ মণ্ডল, মহিউদ্দিন আহমেদ, সিনহা এম সাঈদ, অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, ফরাসউদ্দিন, সাবেক সচিব আবু আলম, ইফতেখারুজ্জামান, খুশী কবির, সঞ্জীব দ্রং, রুবায়েত ফেরদৌস ও শাহীন আনাম।
গভর্ন্যান্স অ্যান্ড রাইট সেন্টারের জহিরুল আলম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান ও সাবেক সচিব মহিউদ্দিন আহমেদ পরে সংলাপে যোগ দেন। এর পরে আসেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. এসএম শামীম রেজা।
সংলাপে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল, রাশেদা সুলতানা, মো. আলমগীর ও আহসান হাবিব খান সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া ওমরাহ পালন করতে যাওয়ায় সংলাপে অনুপস্থিত ছিলেন নির্বাচন কমিশনার (ইসি) আনিছুর রহমান। এ ছাড়া ইসি সচিবসহ কমিশনের অন্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
2022-04-09 16:35:01
2022-04-09 06:35:01