শুকনা মওসুমে তিস্তা নদীর পানি ধরে রাখতে গৃহিত প্রকল্পের জন্য চীনের কাছ থেকে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের ঋণ পাচ্ছে বাংলাদেশ। সরকারী সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে। নদীর পানি বণ্টনের জন্য ভারতের সাথে চুক্তির সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।
মে মাসে অর্থ মন্ত্রণালয় বৃহত্তর রংপুরে তিস্তা রিভার কম্প্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যাণ্ড রেস্টোরেশান প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ৮৫৩ মিলিয়ন ডলার চেয়েছিল। এই ঋণের মাধ্যমে বাংলাদেশের কোন নদী ব্যবস্থাপনা প্রকল্পে প্রথম বারের মতো যুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশ।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত চিফ ইঞ্জিনিয়ার জয়তী প্রসাদ ঘোষ বেনারনিউজকে জানান, “তিস্তা নদীর পানি ব্যবস্থাপনার জন্য একটা বিশাল প্রকল্প নেয়া হয়েছে এবং চীন এখানে অর্থায়নে রাজি হয়েছে। আশা করা যায় ডিসেম্বরে আমরা কাজ শুরু করতে পারবো”।
তিস্তা প্রকল্পে ব্যায় হবে প্রায় ৯৮৩ মিলিয়ন ডলার। নয়টি প্রকল্পের জন্য বেইজিংয়ের কাছে ৬ বিলিয়ন ডলার চেয়েছে ঢাকা। তার মধ্যে এটি অন্যতম। এর বাইরে অবকাঠামো প্রকল্পের জন্য এর আগে বাংলাদেশকে ২২ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বেইজিং।
ঘোষ বলেন, “তিস্তা নদী চওড়ায় কোথাও এক কিলোমিটার, কোথাও পাঁচ কিলোমিটার। আমরা নদীর প্রস্থকে এক কিলোমিটারের নামিয়ে আনবো এবং অন্তত ১০ মিটার গভীর করা হবে এটা, যাতে শুকনা মওসুমে পানি ধরে রাখা যায়”।
বর্ষায় বন্যায় প্লাবিত হলেও শুকনা মওসুমে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নদীতে প্রায় পানিই থাকে না।
উৎস ভারতে
বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে যে ৫৪টি অভিন্ন নদী রয়েছে, তার মধ্যে তিস্তা একটি, যেটার উৎপত্তিস্থল ভারতে।
ভারতের সিকিম থেকে উৎপত্তি হয়েছে নদীটি বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বন্যার সময় বাংলাদেশের ২,৭৫০ বর্গকিলোমিটার জায়গা এর আওতায় পড়ে যায়।
তিস্তা নদীর রাজনৈতিক অর্থনীতি নিয়ে এশিয়া ফাউণ্ডেশানের এক রিপোর্টে এটাকে বাংলাদেশের চতুর্থ বৃহত্তম আন্তদেশীয় নদী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। উত্তরাঞ্চলীয় পাঁচটি জেলা – গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারি ও রংপুরের ভেতর দিয়ে গেছে এই নদী।
গবেষণা বলছে, বাংলাদেশের অন্তত ২১ মিলিয়ন মানুষ সরাসরি বা পরোক্ষভাবে জীবিকার জন্য এই নদীর উপর নির্ভরশীল। এদের একটা অংশ মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে।
বাংলাদেশের কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছেন যে, প্রতি বছর তিস্তার পানি নাটকীয়ভাবে কমে গেছে কারণ ভারত তাদের দিক থেকে পানি বন্টন চুক্তিতে রাজি হয়নি এবং ভারতের ভিতরে নদীর উজানে বাধ দেয়া হয়েছে।
এক পরিবেশবিদ অবশ্য চীনা অর্থায়নে নদী পুনর্গঠন প্রকল্প নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন।
পরিবেশবিদ আইনুন নিশাত বেনারনিউজকে বলেন, “উজান থেকে তিস্তার সাথে বিপুল পলি চলে আসে। বর্ষায় পানির সাথে এর বড় একটা অংশ আসে। তিন বছর পরেই নদীতে আবার পলি জমে বন্যা শুরু হবে”।
নিশাত বলেন, “পানি উন্নয়ন বোর্ড যেভাবে নদীর প্রস্থ কমিয়ে আনতে যাচ্ছে, সেটা নদীর ক্ষতি করবে এবং মাছ সম্পদ কমে আসবে”। পানি সম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ নিশাত বাংলাদেশের ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে প্রফেসর এমেরিটাস হিসেবে কর্মরত আছেন।
বহু দশকের দর কষাকষি
তিস্তা ইস্যু দীর্ঘদিন ধরে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে কাঁটা হয়ে আছে।
নিশাত বলেন, ১৯৫১ সালে ভারত এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান নদীর পানি বন্টন নিয়ে দর কষাকষি শুরু করেছিল। সাত দশক পরেও চুক্তি স্বাক্ষর হয়নি এবং কর্মকর্তারা এখনও আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন।
২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর আলোচনার গতি বাড়ে। ভারত ৪২.৫ শতাংশ এবং বাংলাদেশ ৩৭.৫ শতাংশ পানি পাবে – এমন হিসেব নিয়ে দর কষাকষি চলে। নদীর গতি ঠিক রাখার জন্য বাকি ২০ শতাংশ অব্যবহার্য হিসেবে রাখার কথা হয়।
২০১১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরকালে চুক্তিটি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এটাকে আটকে দেন।
পশ্চিম বঙ্গ আর সিকিমের উপর দিয়ে এসেছে এই নদী। ব্যানার্জি বলেছিলেন যে, চুক্তি হলে তার রাজ্যের কিছু অংশ শুকিয়ে যাবে।
ভারতের সংবিধানের অধীনে, সংশ্লিষ্ট রাজ্যের সম্মতি ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকার পানি ইস্যুতে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।
গত বছর হাসিনার নয়াদিল্লী সফরকালে তিনি ভারত সরকারের প্রতি জোর দাবি জানান যাতে ২০১১ সালের মধ্যে তিস্তা চুক্তি চুড়ান্ত করা হয়।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি হাসিনাকে বলেন যে, তার সরকার চুক্তি নিয়ে সব পক্ষের সাথে কাজ করছে।
বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশনের একমাত্র সদস্য মাহমুদুর রহমান বেনারনিউজকে বলেন, “এই মুহূর্তে তিস্তা চুক্তি নিয়ে কোন অগ্রগতি হচ্ছে না”।
নদীর পানি চুক্তি নিয়ে বেনার নিউজের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হলে ব্যানার্জি বা পশ্চিমবঙ্গের অন্য কোন কর্মকর্তা এ ব্যাপারে কোন মন্তব্য করেননি।
2021-01-30 06:29:31
0000-00-00 00:00:00