আমার স্ত্রী রুপা আমাকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে।
অবশ্য তাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। তার সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে।
কারণ আমাদের বংশ হল পাগলের বংশ।
আমার মনে আছে আমি যখন খুব ছোট ছিলাম। আমার দাদি শরীরের সব পোশাক খুলে উলঙ্গ হয়ে পুরো বাড়ি দৌড়াদৌড়ি করতো।
বাসায় কোন গেস্ট আসলে তার সামনে যেয়ে বলতো, এই যে দেখো আমি নেংটা আমি নেংটা।
আমার বাবা শেষ পর্যন্ত দাদীকে একটা রুমে আটকে রেখে, বাইরে থেকে তালা দিয়ে রাখতেন।
দাদি বদ্ধ রুমে থাকতে খুব ভয় পেত। তখন জানালার শিক ধরে চিৎকার করে কান্না করত। আমি আর নেংটা থাকব না। কেউ দরজাটা খুলে দাও। আমার ভয় করছে।
কখনো কখনো দরজা ধরে খুব ঝাঁকাতো।
ভেতর থেকে দাদি কাঁদতো। দরজার বাইরে বসে বাবা কান্না করত।
কান্না করতে করতে ক্লান্ত হয়ে দাদি শরীরের সব কাপড় খুলে ফ্লোরেই ঘুমিয়ে যেতো।
সেই সময় আমাকে দেখাশোনা করতো মকবুল ভাই।
খুব বেশি বয়স না। বারো তেরো হবে। সে খুব মজা পেত দাদিকে দেখে।
প্রায় সময় দেখা যেত আশেপাশে কেউ না থাকলে আমাকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে, জানলার শিক ধরে এক দৃষ্টিতে ভেতরে তাকিয়ে থাকতো।
আর ফিক ফিক করে হাসতো। মাঝে মাঝে আমাকেও উঁচু করে দেখাতো। আর বলতো, বুঝলা অনি ভাই পৃথিবীতে এর চাইতে মজার দৃশ্য আর নাই।
কথায় আছে চোরের দশ দিন, গৃহস্থের একদিন।
মকবুল ভাই একদিন বাবার হাতে নাতে ধরা পড়ল।
প্রতিদিনের মত আমাকে পাশে নামিয়ে রেখে জানালার শিক ধরে মকবুল ভাই ফিক ফিক করে হাসছিল।
বাবা পিছন থেকে গলা চেপে ধরলো প্রথমে।তারপর ইচ্ছে মত মাইর, মেরে রক্তাক্ত করে দিল।
তারপর বাবা নিজেই আমাদের পারিবারিক ডাক্তার এনে চিকিৎসা করালো।
মাইর খেয়ে মকবুল ভাই এতোই কাবু হয়ে গেছিলো যে,তিন দিন বিছানা থেকেই উঠতে পারলো না। পুরো শরীর ব্যান্ডেজ করা। দেখলেই ভয় লাগতো।
আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, তারপরও মকবুল ভাই এ বাড়িতেই থেকে গেল।
থেকে গেল মানে এখনো আছে। এ বাড়িতেই আছে। আমার বিশ্বস্ত এ্যাসিস্টেন্ড।
দাদির মৃত্যুর কিছুদিন পর বাবার মস্তিষ্ক বিকৃতি দেখা দিল। তাকে মেন্টাল হোমে ভর্তি করা হয়। তার মৃত্যুও হয় মেটাল হোমে।
এ ধরনের পরিবারের ছেলে হিসেবে আমাকে সন্দেহ করতেই পারে আমার স্ত্রী।
তাছাড়া আমার চলাফেরা, আচার-আচরণ ও আর দশটা সাধারণ মানুষের মতো না।
যেহেতু আমার বাবা অটেল সম্পত্তি রেখে গিয়েছেন। তাই আমি ঘরে বসেই রাজার হালে দিন কাটাই।
অধিকাংশ সময় আমার কাটে বই পড়ে আর গাছের সাথে কথা বলে।
ও আচ্ছা একটা তথ্য আপনাদের দেওয়া হয়নি। আমি একজন শখের বোটানিস্ট।
বই পড়ে পড়ে আমার গাছ সম্পর্কে অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমি গাছ দের সাথে কথা বলতে পছন্দ করি।
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে ছাদে চলে যাই। সেখানে আমার একটা খাটিয়া আছে। খাটিয়ায় শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখি।
কখনো তারাদের সাথে কথা বলি।
ঠিক এমনই এক রাতে আমার ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর আমি ছাদে শুয়ে আছি।
নিজের মনে তারাদের সাথে কথা বলছি।
হঠাৎ সিলভার এসে বলল, কি করছো তুমি? কার সাথে কথা বলছো?
ও আচ্ছা আপনাদের তো বলা হয়নি আমি বাসর রাতেই রুপার নাম বদলে দেই।
রুপাকে আমি সিলভার ডাকি।
বাসর রাতের গল্প টা আপনাদের একটু পরে বলছি।
যা বলছিলাম, সিলভারের কন্ঠ শুনে আমি ওর দিকে তাকালাম।
দেখলাম ওর চোখে ভয় ও বিস্ময় দুটোই একসাথে।
আমি খুব শান্ত ভাবে উত্তর দিলাম তারার সাথে কথা বলছি।
এস তুমিও আমার পাশে এসে শোও।দেখো খুব মজার ব্যাপার।
আমার স্ত্রী কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, তুমি কি পাগল হয়ে গেছো!
আমি আরো ঠান্ডা সুরে বললাম,মাঝ রাতে তারা ভরা আকাশ এর সৌন্দর্য সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষের কোন ধারণা নেই।
তাই তারা এই সৌন্দর্য দেখা থেকে বঞ্চিত। এর মধ্যে পাগলামির কিছু নেই সিলভার।
সিলভার আরও কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, এর মধ্যে পাগলামি কিছু নেই! পৃথিবীর কেউ কখনো শুনেছে, নববধূকে ঘরে একা রেখে মাঝরাতে তার স্বামী ছাদে একা একা শুয়ে থাকে!
সিলভার আমাকে যতই সন্দেহ করুক না কেন, প্রচন্ড রকম ভালোও বাসে।
ওর প্রধান কাজ হলো আমার পেছন পেছন ঘোরা। সারাদিন আমার সাথে আঠার মতো লেগে থাকা। As like a super glue!
প্রতিটি মেয়ে নতুন বিয়ের পর তার সংসার গুছানো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায়। সব জিনিস সরিয়ে তার নিজের পছন্দমত ঘর সাজায়। নতুন নতুন রান্না করে স্বামীকে চমকে দেয়।
কিন্তু সিলভার সম্পূর্ণ বিপরীত।সে আমাকে না দেখে এক মুহূর্ত থাকতে পারে না। আমি যখন গাছের সাথে কথা বলি, সে একটা মোড়া নিয়ে আমার পাশে বসে বড় বড় চোখ করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
রুপার সাথে আমার বিয়ে ঘটনাটাও কিন্তু দারুন মজার।
রুপার বাবা-মা রোড অ্যাকসিডেন্টে মারা যাওয়ার পর খুব ছোটবেলা থেকেই মামার সংসারে মানুষ । রুপার মামাতো বোন পারুল এর সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। পারুলরা দুই বোন।পারুল আর শিমুল।
যথা সময় আমাদের বিয়ে পড়ানোও হয়েছে।
বিয়ের কিছুক্ষণ পর মুরুব্বিরা মিলে ঠিক করলো, ছেলের যেহেতু বাবা-মা বেঁচে নেই।বাসর রাত এ বাড়িতেই হোক।
পরের দিন না হয় উঠিয়ে দেওয়া যাবে।
এ বাড়িতে আমাকে রাখার পেছনে আরও একটা কারণ ছিল,যেটা আমি পরের দিন জেনেছি। পারুল সম্ভবত এই বিয়েতে রাজি ছিল না।
কিন্তু রুপার মামা কিছুতেই এই ছেলে হাতছাড়া করবে না। এত বড় ঘরে মেয়ে বিয়ে দিতে পারাটা সে তার সাত জনমের ভাগ্য বলে মনে করে।
এদিকে পারুল চাপে পড়ে কোনমতে কবুল বললে ও, এমন কান্নাকাটি শুরু করলো। যে সে কিছুতেই শ্বশুর বাড়িতে যাবে না।সবাই মিলে ঠিক করলো একটা রাত না হয় এ বাড়িতেই থাকুক জামাইসহ।
সবাই মিলে বুঝিয়ে শুনিয়ে কাল শ্বশুর বাড়িতে পাঠানো যাবে।
আমি কান্নাকাটি একদম সহ্য করতে পারি না। পারুলের নাকি কান্না দেখে গা জ্বলে যাচ্ছিল।এমন রূপবতী একটা মেয়ে নতুন বউ সেজে ফ্যাচর ফ্যাচর করে কান্না করছে দৃশ্যটা আমার কাছে জঘন্য লাগছিল।
আমি ফ্রেশ হয়ে আসার পরও দেখি সে কেঁদেই যাচ্ছে। কোন থামাথামি নেই। হঠাৎ করে আমার এত রাগ উঠলো!
কথাটা বোধহয় একটু শক্ত হয়ে গেছিল।আমি বেশ কঠিন স্বরে বললাম কান্নাকাটি করতে হয় দূরে গিয়ে কাঁদো।
আমি ক্লান্ত। একটু আরাম করে ঘুমাতে চাই। আমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম।
আমি আবার খুব ঘুম কাতুরে। শোয়ার সাথে সাথে ঘুম। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে।
আমি পায়ের শব্দ পেলাম। পারুল বারান্দার দিকে যাচ্ছে।
ভোরের আজানের সময় আমার ঘুম ভেঙ্গেছে পাখির ডাকে।
জেগে দেখি পারুল পাশে নেই।
বিছানা দেখে যা বুঝলাম, রাতে ও শোয়নি। রুমে ও নেই।
যতদূর মনে পড়ে। রাতে আমি ভেতর থেকে লক করে শুয়ে ছিলাম। কিন্তু সিটকানি খোলা।
আমি খুব একটা পাত্তা দিলাম না।আছে হয়তো অন্য কোন রুমে। অথবা নতুন জামাইয়ের জন্য নাস্তা রেডি করছে।
পর্ব-১
ধারাবাহিক চলবে….
রোকেয়া পপি
বাংলাদেশ
2021-03-14 16:46:26
2021-03-14 05:46:26