জনগণই-টানছে-ঘানি,-ভোজ্যতেলের-নৈরাজ্য-থামেনি

নিজস্ব প্রতিবেদক: বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধির কথা বলে বার বার ভোজ্যতেলের মূল্য বাড়িয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। আর এই বাড়তি দামে তেল কিনতে গিয়ে করোনা মহামারির ধাক্কার পর আরো পিষ্ট হচ্ছেন শ্রমজীবী ও সীমিত আয়ের মানুষ। আন্তর্জাতিক বাজারে যেভাবে দাম বাড়ছে দেশের বাজারে তার চেয়ে অনেক বেশি দাম বেড়েছে সয়াবিনের। কিন্তু দাম বাড়লেও সরবরাহ সংকটের কোনো সুরাহা হয়নি। রাজধানীর খুচরা বা পাইকারি বাজারে ভোজ্যতেলের সন্ধানে গিয়ে খালি হাতেই ফিরতে হচ্ছে ক্রেতাদের। ফলে ভোজ্যতেলের বাজারে নৈরাজ্য কমেনি।
সাধারণ জনগণ ভোক্তা ও বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, ব্যবসায়ীরা বার বার আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে দাম বাড়ান। আন্তর্জাতিক বাজারে যে পণ্যটির দাম বেড়েছে তা বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশ করতে কমপক্ষে ২-৩ মাস সময় লাগবে। আর আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে তারা আবার বলেন বেশি দামে কেনা। তাই আগের দামে কেনা হলেও শুধু ঘোষণার কারণেই বাড়তি দামে বিক্রি করে এক দিনে ব্যবসায়ীরা লুটে নিচ্ছে শত কোটি টাকা। করোনা ও ওমিক্রনের কারণে অধিকাংশ মানুষ আয় রোজগার হারিয়ে পর্যুদস্ত। সেখানে, যারা দাম বাড়ানোর অনুমতি দিয়েছেন, তারা কি একবারও চিন্তা করেছেন, দেশের মানুষের এত চড়া দামে ভোজ্যতেল কেনার সামর্থ্য আছে কিনা। তারা বলছেন, ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন আর সরকার দফায় দফায় দাম বাড়ানোর অনুমতি দিচ্ছেন। দেশের সাধারণ মানুষের কথা কেউ ভাবছে না। সরকারও দেশের মানুষের কথা চিন্তা না করে ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখছে। বিগত দু-এক বছর ধরে দেশের বাজারে দফায় দফায় যে হারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানো হয়েছে, বিশ্বের কোনো দেশে এভাবে এত দাম বাড়ানো হয়নি। কিন্তু এবার যে হারে বাড়ানো হলো তাতে দেশের মানুষের সঙ্গে অন্যায্য কাজ করা হলো। বাণিজ্য সচিবের সঙ্গে গত বৃহস্পতিবার মিল-মালিকদের বৈঠকের পর সয়াবিন ও পাম অয়েলের দাম নির্ধারণ করে দেয় সরকার।
নির্ধারিত দাম অনুযায়ী, ভোক্তাপর্যায়ে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ১৯৮ ও খোলা সয়াবিনের প্রতি লিটার ১৮০ টাকায় বিক্রি হবে। এর আগে বোতলজাত এক লিটার সয়াবিনের দর ছিল ১৬০ টাকা। খোলা তেল ছিল ১৩৬ টাকা লিটার। অর্থাৎ আগের চেয়ে বোতলজাত সয়াবিন তেলে লিটারপ্রতি ৩৮ টাকা ও খোলা তেলে লিটারপ্রতি ৪৪ টাকা বেড়েছে। পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৯৮৫ টাকা। আগে পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৭৬০ টাকা। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রতি লিটার পাম অয়েল বিক্রি হবে ১৭২ টাকায়।
এদিকে, মূল্য সমন্বয়ের তিনদিন পরও রাজধানীর বাজারে মিলছে না সয়াবিন তেল। আজ এ তেল হাতে আসতে পারে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। কারওয়ান বাজার ও হাতিরপুল বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, খুচরা ব্যবসায়ীদের নতুন করে তেল সরবরাহ করেননি সংশ্লিষ্টরা। তেলের জন্য অপেক্ষা করছেন তারা। একাধিক খুচরা ব্যবসায়ী জানান, শনিবার ব্যাংক বন্ধ। রোববারে ব্যাংকে চাহিদাপত্রের (ডিও) টাকা জমা দেওয়ার পর আজ সোমবারে তেল পাওয়া যেতে পারে। গতকালও তেলের জন্য দোকানে দোকানে ঘুরতে দেখা গেছে হাজার হাজার ক্রেতাকে। তাদের একজন মোহাম্মদপুর বাজারে আসা করিম মুন্সি।
তিনি বলেন, হাতিরপুল, গ্রিন রোডের আট থেকে ১০টি দোকান ঘুরেও কোথাও তেল না পেয়ে এখানে এসেছি, কিন্তু এখানেও একই অবস্থা। গত শনিবার বাজারে শুনলাম রোববার থেকে তেল পেতে সমস্যা হবে না, কিন্তু কোথাও সয়াবিন তেল পাইনি। এরআগে ভোজ্যতেলের বাজার বিশেষ করে সয়াবিনের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছিল। সেই উদ্যোগের ফলে সয়াবিন ও পাম অয়েলের দাম কিছুটা কমলেও ইন্দোনেশিয়ায় রফতানির ওপরে নিষেধাজ্ঞার খবরে অস্বাভাবিক হয়ে উঠে সয়াবিন তেলের বাজার। একদিনের ব্যবধানে খুচরা পর্যায়ে কেজিতে খোলা সয়াবিন ও পাম অয়েলের দাম ২০ টাকা বেড়ে যায়। সামনে দাম আরো বাড়তে পারে বলে ইঙ্গিত দেন ব্যবসায়ীরা। এই সুযোগ কাজে লাগাতে ব্যবসায়ীরা সয়াবিন তেল বিক্রি বন্ধ করে দেন। একইসঙ্গে গুজব ছড়ায় যে বাজারে সয়াবিন তেল নেই। অনৈতিক মুনাফার আশায় হাজার হাজার লিটার সয়াবিন তেল যে যেভাবে পারছেন, সেভাবেই লুকিয়ে রাখেন। অসাধু ব্যবসায়ীদের ওই অবৈধ মজুতে সরকারের পক্ষে প্রতিদিনই হানা দেয় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। ঈদের আগে রাজধানীর কাওরান বাজারের পাইকারি দোকানগুলোতে অসাধু ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে সয়াবিন ও পাম তেলের বাজার অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছিলেন। কয়েকজন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে এমন কিছু সুনির্দিষ্ট অভিযোগও ছিল। যার ভিত্তিতে কয়েকটি দোকানে অভিযান চালানো হয়। এ সময় দুই হাজার লিটার সয়াবিন তেল উদ্ধার করে ভোক্তা অধিদফতরের ভ্রাম্যমাণ আদালত।
কিন্তু সংশ্লিষ্টরা আগেই জানিয়েছিলেন, ইন্দোনেশিয়া পাম অয়েলের কাঁচামাল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় সারা বিশ্বে এর প্রভাব পড়বে। কারণ, ইন্দোনেশিয়া বিশ্বের বৃহত্তম পাম অয়েল উৎপাদনকারী দেশ। এতে পাম অয়েলের পাশাপাশি সয়াবিনসহ অন্যান্য ভোজ্যতেলের দাম বেড়ে যাবে। ভোজ্যতেলের দাম বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের দামও বাড়বে। এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী বাড়ানো উচিত। এক্ষেত্রে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে ভোজ্যতেল বিক্রি কার্যক্রম বাড়ানো যেতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ গোলাম মাওলা সম্প্রতি বলেছিলেন, সারা বিশ্বে পাম অয়েলের বড় জোগানদার ইন্দোনেশিয়া। এখন দেশটি পাম অয়েলের কাঁচামাল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়ায় শুধু বাংলাদেশ না, সারা বিশ্বে এর প্রভাব পড়বে। ইন্দোনেশিয়ার এ নিষেধাজ্ঞার কারণে সব ধরনের ভোজ্যতেলের দাম বাড়বে। ভোজ্যতেলের বাজারে আবারো আগের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। সরকারের উচিত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ভর্তুকির ব্যবস্থা করা। এ বিষয়ে সিটি গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, ইন্দোনেশিয়ার নিষেধাজ্ঞার ফলে বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানসহ সারা বিশ্বে এর প্রভাব পড়েছে। দেশের বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। তবে আমরা ভোজ্যতেলের সরবরাহ ঠিক রেখেছি।

2022-05-10 08:45:40

2022-05-10 08:45:40

Published
Categorized as 17

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *