একদিন একটা পেনড্রাইভ হাতে দিয়ে ছেলে বললো-
পাপা, দেখোতো আমার রিপোর্টটা কেমন হয়েছে?
চালিয়ে দেখলাম। এতো পুরোপুরি টিভিতে খবর পাঠের ভিডিও! ওদের ক্লাসের একটা মেয়ে নিউজ প্রেজেন্ট করছে আর বিভিন্ন বিষয়ে রিপোর্টের জন্য একে একে চলে যাচ্ছে সহপাঠী রিপোর্টারদের কাছে!
ছেলে আগে থেকেই বাবার কাজ নিয়ে রিপোর্ট তৈরি করবে ঠিক করেছিল। তাই ওকে পানিদূষণের কারণ, পরিবেশের উপর এর খারাপ প্রভাব, পানি বিশুদ্ধকরণের উপায়গুলো নিয়ে তালিম দিয়েছিলাম! পরে শুনলাম, ওদের স্কুলটিচার ওদেরকে একটা ডিজিটাল স্টুডিওতে নিয়ে গিয়েছিল। বাচ্চারা রিপোর্ট প্রেজেন্ট করেছে, স্টুডিওর ক্যামেরাম্যান ভিডিও শেষে বাচ্চাদেরকে নিয়ে ভিডিও এডিটিং করেছে। টিচার গোপনে সবার গ্রেডিং করেছে।
আরেকদিন সে তার মায়ের কাজ নিয়ে ওর প্রোজেক্টের প্রেজেন্টেশনও ভিডিও করে এনেছিল। বিষয় ছিল, জার্মানির গাড়ি ইন্ডাস্ট্রি এবং গাড়ি তৈরির আদ্যোপান্ত। এটা ওর ৪র্থ শ্রেণীতে থাকাকালীন ঘটনা।
বাংলাদেশের শিক্ষাজীবনে স্কুল, কলেজ, এমনকি বুয়েটের মতো স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়েও কখনও কোনো বিষয়ে প্রেজেন্টেশন না দিয়েও সার্টিফিকেট পাওয়া আমি শুধু ভিডিওগুলো দেখি আর ভাবি! বাচ্চারা শুধু একটা নির্দিষ্ট টপিকে জানলোই না, নিউজ রিপোর্ট তৈরি করা শিখলো, টিভি ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে মনের ভয়-জড়তা কাঁটালো, ভিডিও এডিটিং শিখলো, প্রেজেন্টেশনে নিজের ভুলগুলো ধরতে পারলো, কারো মনে স্বপ্নও তৈরি হলো বড় হয়ে নিউজ প্রেজেন্টর বা জার্নালিস্ট হবার!
জার্মান শিক্ষাব্যাবস্থায় প্রাইমারি স্কুলের ৪র্থ শ্রেণীর পর বাচ্চাদেরকে সুনিপুণভাবে আলাদা করে ফেলা হয়। প্রাইমারী স্কুলের রেকমেন্ডেশন অনুযায়ী বাবা-মা সিদ্ধান্ত নেয় বাচ্চার কোন ধরণের হাই-স্কুলে যাওয়া উচিত। যারা কম মনোযোগী বা একটু ধীরে শেখে, তারা যায় সাধারণ সেকেন্ডারি স্কুলে যেখানে পড়ার চাপ অপেক্ষাকৃত কম। স্কুল শেষে তারা পছন্দের কোনো বিষয়ে ২-৩ বছরের একটা ট্রেনিং করে কল-কারখানা, অফিস-আদালতে জব সেক্টরে ঢুকে পড়ে।
আর যেসব বাচ্চারা খুবই তাড়াতাড়ি ক্যাচ করে, সব বিষয়েই চরম আগ্রহ ও ভালো গ্রেড পায়, তারা চলে যায় একাডেমিক সেকেন্ডারি স্কুল বা গিমনাজিউম এ। ছেঁকে ছেঁকে ফাইন টিউনিং করে এরা বের করে আনে ভবিষ্যতের ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, বিজ্ঞানী আর গবেষকদেরকে। যারা খেলাধুলায় ভালো বা খুব ভালো পিয়ানো বাজাতে পারে, তাদেরকেও একইভাবে পরিচর্যা করতে করতে ভবিষ্যতের টমাস মুলার, মার্কো রয়েস, বরিস বেকার বা অলিম্পিক গোল্ড মেডেলিস্ট হিসেবে তৈরি করে।
গত সপ্তাহ থেকে আমাদের ছেলে জায়ান স্থানীয় একটা একাডেমিক সেকেন্ডারি স্কুলের ৫ম শ্রেণীর যাত্রা শুরু করেছে। যেদিন এই হাই-স্কুলটা পরিদর্শনে গিয়েছিলাম, মাথা ঘুরে যাওয়ার দশা! জীবনের প্রথম থ্রি-ডি প্রিন্টার দেখলাম এবং ৭ম/৮ম শ্রেণীর ২ টা বাচ্চা জলজ্যান্ত আইফেল টাওয়ার প্রিন্ট করে দেখালো সবাইকে। আইটি ল্যাবে ৫ম/৬ষ্ঠ শ্রেণীর বাচ্চারা ডেস্কটপ কম্পিউটার খুলে পার্টট-বাই-পার্ট জোড়া দিচ্ছে, ফিজিক্স ল্যাবে থরে থরে সাজানো আইনস্টাইন, ওহম, ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক, ফ্রাউনহফার, হাইজেনবার্গদের সূত্র বোঝানোর জন্য তৈরি প্রোজেক্ট মডেল, জিওগ্রাফী ল্যাবে অগ্ন্যুৎপাতসহ আগ্নেয়গিরি-আল্পস পর্বতমালা বানানো, স্পেস ল্যাবরেটরিতে সোলার সিস্টেম দেখার ও বানানোর যন্ত্রপাতি!
বারবার শুধু মনে হচ্ছিল, ছেলের সাথে সাথে আমি নিজেও যদি এই স্কুলে ভর্তি হতে পারতাম!
জার্মান ভাষার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষা শেখা শুধু বাধ্যতামূলকই নয়, ৭ম ও একাদশ শ্রেণীতে ওদেরকে ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ডে নিয়ে গিয়ে হাতে একটা ম্যাপ দিয়ে ছেড়ে দিবে ১৫ দিনের জন্য। শুধু ভয়েস, ন্যারেশন আর ট্রান্সলেশন মুখস্ত লিখে ‘জিপিএ ফাইভ’ পাওয়া না, একবারে ইংরেজদের মাটিতে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে ইংরেজি ঝালাই করে নিয়ে আসা হবে! সঙ্গে অবশ্যই আরেকটা বিদেশী ভাষা হিসেবে শিখতে হবে ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ, অ্যারাবিক বা ল্যাটিন, যার যেটা ইচ্ছে। এথিকস বা মানবিক শিক্ষার উপর পুরো আলাদা একটা পাঠ্যবই। ভাবা যায় এগুলো!
আমার ক্ষমতা থাকলে বাংলাদেশের অন্তত ৫০০ স্কুলের প্রধান শিক্ষষক-শিক্ষিকাকে জার্মানির প্রাইমারি, সেকেন্ডারি স্কুলগুলো পরিদর্শন করাতে আমন্ত্রন জানাতাম! শুনেছি ফিনল্যান্ড, নরওয়ের শিক্ষাব্যাবস্থাও খুব ভালো। এশিয়ার মধ্যে জাপান, সিঙ্গাপুর। ৫০ বছর পরেও যদি আপনি ভালো মানের আম খেতে চান, তবে ভালো মানের আমের বীজ এখনই রোপণ করে প্রতিদিন পরিচর্যা করতে হবে আপনাকে। বাতাবী লেবুর গাছ লাগিয়ে আপনি তো আর আমের ফলন আশা করতে পারেন না, তাই না!
একটা রাষ্ট্রের শুধুমাত্র শিক্ষাব্যাবস্থার হালচাল দেখলেই পরিষ্কার বোঝা যায় সেই দেশ জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, শিল্প-সাহিত্যে কেমন উন্নত। বলাই বাহুল্য, কেন জার্মানরা দুই দুইটি বিশ্বযুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েও পৃথিবীর বুকে অর্থনৈতিক পরাশক্তি হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে!
খাজা রহমান
জার্মানি।
2021-01-30 06:29:31
0000-00-00 00:00:00