গালোয়ান সংঘাতে ভারতীয় ভূখণ্ড দখল করে নিয়েছে চীন

হিমালয়ে তীব্র শীতের মৌসুমের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছে চীন ও ভারতের সেনারা। পাহাড়ি এলাকায় হিমশীতল ঠাণ্ডার মধ্যেই বাঙ্কার আর ঘাঁটিতে অবস্থান নিচ্ছে তারা। কিন্তু, এই প্রস্তুতির মধ্যেই গত গ্রীষ্মে উভয়পক্ষের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘাতের ফলও স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

ওই উত্তেজনার ফলস্বরূপ: এক সময় ভারত যে এলাকায় টহল দিত, চীন তার বড় একটা অংশ নিজেদের আয়ত্বে আনতে পেরেছে।

গত জুনে গালোয়ান উপত্যকায় চীনা গণমুক্তি ফৌজের সঙ্গে হাতাহাতি সংঘর্ষে ২০ ভারতীয় জওয়ান নিহত হয়। তারপর থেকেই বিতর্কিত পাহাড়ি এলাকায় ৩০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে ভারত।

অধিকৃত এলাকায় এখন ভারতীয় সেনা টহলে বাধা দিচ্ছে চীন। আর নতুন করে দখলে নেওয়া ওই এলাকার আয়তন নিউইয়র্ক শহরের প্রাণকেন্দ্র ম্যানহাটন দ্বীপের চাইতে প্রায় পাঁচগুণ বড়।

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে হাজার হাজার মিটার উঁচুতে হিমালয়ের বিতর্কিত সীমান্ত অঞ্চল প্রকৃতপক্ষে হিমশীতল রুক্ষ-পাথুরে মরুভূমি। তবে অঞ্চলটির কৌশলগত ও সামরিক গুরুত্ব অনন্য। গত ছয় দশক আগে সর্বপ্রথম এ অঞ্চলে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে চীন ও ভারত।

তারপর দীর্ঘ কয়েক দশক লাদাখে চীনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়নি ভারতকে। কিন্তু, সীমান্ত এলাকায় ভারতীয়দের সড়ক ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের প্রেক্ষিতে সাম্প্রতিক সময়ে ফের তৎপর হয়ে ওঠে গণমুক্তি ফৌজ। দুইপক্ষের মধ্যে স্নায়বিক উত্তেজনাও তুঙ্গে।

তাই শীতে তাপামাত্রা শূন্যের ৪০ ডিগ্রী নিচে নামলেও, ওই পরিবেশে জনবিরল সীমান্ত এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মুখোমুখি অবস্থান বজায় রাখার প্রস্তুতি নিচ্ছে দুই দেশের সেনাবাহিনী।

ভারতীয় সেনাবাহিনীর উত্তরাঞ্চলীয় কমান্ডের সাবেক প্রধান লে. জেনারেল ডি.এস. হুদা। সাগরপৃষ্ঠ থেকে ১৮,১৭৬ ফুট উচ্চতায় হিমালয় পর্বতমালা জুড়ে বিস্তৃত দুর্গম সীমানা রক্ষার দায়িত্ব ছিল তার কাঁধে।

হুদা বলেন, ১৯৬২ সালের যুদ্ধের পর শীতকালে সেনা মোতায়েনের এমন নজির আমরা আগে কখনই দেখিনি। দুই পক্ষের সেনাই বাঙ্কার খুঁড়ে শীতকালে অবস্থান করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। উত্তেজনা দীর্ঘকাল থাকবে এটা তারই ইঙ্গিত। আর যেকোন সময় অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটে যেতেও পারে।

ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯১৪ সালে তিব্বত ও ভারতের মধ্যে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা নির্ধারণ করা হয়। চীন তা মানে না। কারণ চীন শাসিত তিব্বত ঐতিহাসিকভাবে লাদাখের একটি বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করতো।

১৯৫৯ সালে তিব্বতে চীনা শাসন বিরোধী এক বিদ্রোহ সংগঠিত হয়। বিদ্রোহ কঠোরভাবে দমন করে বেইজিং। এবং পলাতক দালাই লামাকে ভারত আশ্রয় দেয়। ওই ঘটনার পর থেকেই উভয় দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রথমে বিচ্ছিন্ন কিছু সংঘর্ষ ঘটে, যা কিছু সময় পর যুদ্ধে রূপ নেয়। এরপর দুই দেশের মধ্যে পাঁচদফা চুক্তি হলেও মাঝেমধ্যেই সংঘাত বন্ধ হয়নি।

সাম্প্রতিক সময়ে দুই পক্ষের উত্তেজনার অন্যতম কারণ কারাকোরাম হাইওয়ে। এটি চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের রাজধানী কাশগড় থেকে ভারতের দাবিকৃত ভূখণ্ড পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে প্রবেশ করেছে। ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের সীমান্ত লাগোয়া এই মহাসড়ক চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডরের ধমনী বলা যায়। আর ভারত শুরু থেকেই এ প্রকল্পের বিরোধীতা করে আসছে।

দেশটি এই মহাসড়কের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। চায় সংঘাতের সময় এর ওপর আঘাত হানার সক্ষমতা ধরে রাখতে। এজন্যেই উত্তর সীমান্তে সহজে সেনা ও সরঞ্জাম মোতায়েনের জন্য বিপুল অর্থব্যয়ে অসংখ্য টানেল, সড়কপথ ও সেতু নির্মাণ করেছে ভারত। চীনের উদ্বেগ তাই অকারণে নয়।

দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং পাকিস্তানের সঙ্গে অর্থনৈতিক করিডরকে চীনের বৈশ্বিক বাণিজ্য পথ- বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের অতি-গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে উল্লেখ করেছেন। এর মাধ্যমে সহজেই মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ এবং আফ্রিকার সঙ্গে বাণিজ্যে অংশ নিতে পারবে চীন। মধ্যপ্রাচ্য থেকে জ্বালানি আমদানিতেও খরচ কমবে, সময়ও বাঁচবে অনেকখানি।

চীন তাই কারাকোরাম হাইওয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায় বিতর্কিত সীমানায় ভারতীয় অংশ নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার মধ্যে দিয়ে।

১৯৬২ সালের যুদ্ধের পর দীর্ঘসময় চীন সীমান্তে প্রায় নিষ্ক্রিয় ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী। কিন্তু, গত এক দশকে বানানো নতুন অবকাঠামো ও ২৫৫ কিলোমিটার মহাসড়ক হয়ে উঠেছে চীনের মাথাব্যথার কারণ। পাশাপাশি ব্রিটিশ আমলে সীমান্তে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নির্মাণ করা বিমান ঘাঁটিগুলোও সংস্কার করেছে ভারত। চীন গত জুনের ঘটনার অনেক আগে থেকেই এসব উন্নয়ন কাজ নজরে রেখেছিল।

চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাই ভারতের অবকাঠামো নির্মাণ উদ্যোগকে উত্তেজনার মূল কারণ বলে উল্লেখ করেছে। ভারতের সঙ্গে সংঘাতে তাদের সেনা হতাহতের সংখ্যা প্রকাশ করেনি দেশটি। কী পরিমাণ সেনা মোতায়েন করা হয়েছে, তার সম্পর্কেও আনুষ্ঠানিক তথ্য দেওয়া হয়নি। তবে দেশটির গণমাধ্যম ভারতীয় নেতৃত্বের খুব বেশি সমালোচনাও করেনি। আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির সুযোগ করে দিতেই, সম্ভবত এমন ছাড় দিয়েছে বেইজিং।

নরেন্দ্র মোদির শাসনামলে ভারত সীমান্তে অবকাঠামো নির্মাণের আগ্রাসী প্রতিযোগীতায় নেমেছে। চীনের জন্য যা ছিল সতর্ক সংকেত। কারণ সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ অবস্থা বদল করার চেষ্টা করা হয়েছে, জানান সাংহাই ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও গণসংযোগ বিভাগের অধ্যাপক চেন জিনইং।

জিনইং বলেন, দুই পক্ষই দৃঢ় প্রত্যয়ী। ছাড় দেওয়ার মনোভাব কেউই দেখাচ্ছে না। এমনটা করা হলে; দুর্বলতা প্রকাশ করা হবে বলেই তারা মনে করছে। সব মিলিয়ে হিমালয়ের সুউচ্চ অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদিভাবে ব্যাপক সেনা মোতায়েন এবং আকস্মিক সংঘাতের হুমকিও উড়িয়ে দেননি এ বিশেষজ্ঞ।

2021-05-04 22:19:17

0000-00-00 00:00:00

Published
Categorized as 18

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *