করোনা কালের একটানা ৫৪৪ দিন বন্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একটা বিষয় নিশ্চিত করেছে- শিশুরা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। মানসিক ভাবে তারা গুটিয়ে নিয়েছে নিজেদেরকে নিজেদের ভেতর। কেউ তাদের ডাকলে, কিছু বললে তারা রেসপন্স করতে সময় নিচ্ছে। আমরা হয়তো এটাকে খুব সাদামাটা ভাবে ধরেই নিচ্ছি ডিভাইস বা ইন্টারনেট নির্ভরতা বলে। আসলে বিষয়টা কি তেমন কিছু নাকি ভিন্ন কিছু যা শিশুদের মনোজগতে কোন বিশাল পরিবর্তন ঘটে দিয়েছে? ঠিক যেমনটি হয় পা ভেঙ্গে একটানা ৪৫/৬০ দিন বিছানায় বেড রেস্ট নিতে বাধ্য হলে। নতুন করে হাঁটতে শিখতে হয় আবার। লম্বা সময় বিছানায় রেস্ট নেয়া মানুষটার সাথে মাটির এক প্রকার বৈরিতা তৈরি হয়। মাটিতে পা রাখা মাত্রই পায়ের তলায় শুরু হয় অদ্ভুত জ্বালা পোড়া, পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করলে শরীর টলে যায়। শরীরের ভোর নিতে চায় না পা।
আমরা প্রত্যেকেই অপেক্ষা করছিলাম স্কুল কবে খুলবে, কবে খুলবে- স্কুল খোলার ঘোষণায় সকলের প্রতিক্রিয়া তারই প্রমাণ দেয়। অথচ ছবির এই মানুষটা ছাড়া আমরা কেউই স্কুল খুলিবার পক্ষে কোন কথা বলা তো দুরের কথা বরং কথা বলেছি স্কুল খোলার বিপক্ষেই। এই যারা আমরা বিপক্ষেই সোচ্চার ছিলাম তারাই উদ্বেলিত হয়ে ফেসবুকে পোষ্ট দিচ্ছি স্কুল খুলেছে, স্কুল খুলেছে। বন্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলাটা ছড়িয়েছে আনন্দের বান-
আমরা দেখেছি দেশ ভাগের পর থেকেই আমাদের দেশে ভাল কিছুই অর্জন করা যায় নাই কোন সংগঠিত আন্দোলন সংগ্রাম ছাড়া। আমাদের সংগঠিত আন্দোলন সংগ্রামের ফসলও অবশ্য আমাদের হাতে থাকে নাই বেশিক্ষণ। সেই শকুনের করাল থাবায় তা হারিয়ে গিয়েছে ক’দিন বাদেই।

১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনের সময় সরকার এনএসএফ নামক গুণ্ডা বাহিনী মোতায়েন করেছিল এই ভাল চাওয়াদের বিপক্ষে। জারি করেছিল ১৪৪ ধারা। চার জন, ছয়জন এর শিক্ষার্থী দল ভেঙ্গেছিল সেই ১৪৪ ধারা একের পর এক মিছিল করে। তারা জানত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা মানেই নিশ্চিত রাইফেল বন্দুক এর গুলি বুকে গেঁথে নেয়া। পেছনে ছিল হাজার হাজার শিক্ষার্থী তারাও প্রস্তুত। একের পর এক মিছিল যাবে। ভাঙ্গবে ১৪৪ ধারা। ঠিক এটাই ছিল ভাষা আন্দোলনের ঘটনা। না, রূপকথা নয়, ইতিহাস নয় এমন কি খবরও নয় বরং বাস্তবতা। এই প্যারা টাইপ করবার সময় শরীরের সব লোম সজাগ হয়ে উঠল- দেখছি ঘটনা চোখের সামনে। আমি জন্মেছি ’৫২ এর ১১/১২ বছর পর। হা আমি দেখছি পুর ঘটনা এইই সত্য।
আবারও মাঠে নামছে এক লক্ষ এনএসএফ (সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বাহিনী), ভিন্ন নামে। সকল মানুষের কণ্ঠ রোধ করবার অভিপ্রায়ে। রাইফেল বন্দুক হাতে নয়, তবে তা হাতে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বার সকল পথ তৈরির নিমিত্তে। প্রোপ্যাগান্ডা, মিথ্যাচার, অপপ্রচার,ইতিহাস বিকৃতিই হবে মূল হাতিয়ার। ১৯৫২ তে মানুষের চিন্তার স্বাধীনতা ছিল। তার সংগঠিত হতে পারত। পারত সংগঠন গড়ে তাদের নিজেদের কথা বলতে। রেসকোর্স ময়দান সহ অনেক অনেক ময়দান ছিল উন্মুক্ত, তারা কি চায়, কেন চায়, বলার অধিকার ছিল। অন্তত বলতে পারত স্পষ্ট ভাষায়। এখন আমাদের বলতে পারাটা- সুযোগ। আমরা নাকি বাক স্বাধীনতায় গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে বাস করি! স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্জন- আমরা লড়াই করি বেঁচে থাকবার জন্য। আমাদের চিন্তার স্বাধীনতাও ঠিক ততো দুর যতদূর পর্যন্ত “একজন পুলিশ মনে না করবে আমার চিন্তা রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর”। ‘পুলিশ মনে না করবে’ কথাটা মাথায় রাখা জরুরি, ধ্যাত চিন্তার স্বাধীনতায় তো নাই, মাথার কাজ কি!?!
রাখাল রাহার এই আন্দোলনের সাথী কেবল রাখাল রাহা; অন্য কেউ নয়। মাঝে মাঝে তার সমমনা বন্ধুরা এই পাগলটার সাথী হয়ে দাঁড়িয়েছে পাশে। ফার্মগেট থেকে সাতরাস্তার পথটায় তার সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়া বাচ্চারা (শিক্ষার্থী) তাকে অদ্ভুত সম্মান শ্রদ্ধা ভালবাসা মেশানো ছালাম দিয়েছে। তার বুকে ঝোলানো লিফলেট পড়েছে, নিজ হাতের আধ-খাওয়া পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বলেছে – আংকেল একটু পানি খাবেন?
কেউ সাথী হয় নাই! কোন অভিভাবক তার পাশে এসে দাঁড়ায় নাই!! প্রত্যেকেই আশা করেছে তার কাজটি অন্য কেউ করে দিক। রাখাল রাহা কাজটি করেছেন। একদম একা করেছেন।
সত্য এই ভাবেই উচ্চারিত হয়। হতে হয়। জানি, কোন সমস্যা যদি শিক্ষার্থীদের কখনও স্কুল খোলার জন্য তৈরি হয়; তখন সব তীর ছুটে আসবে রাখাল রাহা এর দিকে। সেই সময় সব কিছু দিয়েই পাশে থাকব তার, সব কিছু দিয়ে। স্যালুট রাখাল রাহা।
আদীল
ঢাকা – ১২.০৯.২০২১
2021-09-30 16:42:33
2021-09-30 06:42:33