পাকিস্তান গত সপ্তাহে সৌদি আরবের এক বিলিয়ন ডলার ঋণ ফেরত দিয়েছে। কাশ্মীর ইস্যুতে ইসলামি বিশ্বের সমর্থন আদায়ে সৌদি আরবের অনুমোদনের ব্যাপারে পাকিস্তান জোর দেয়ার প্রেক্ষাপটে এই ঘটনা ঘটল। চীনের কাছ থেকে আরেক দফা ঋণ নিয়ে সৌদি আরবের ঋণ পরিশোধ করে পাকিস্তান।
গত ২০১৮ সালের নভেম্বরে সৌদি আরব পাকিস্তানকে ৬.২ বিলিয়ন ডলারের ঋণ প্যাকেজ অনুমোদন করেছিল। এটি ছিল তারই অংশ। ওই সময় পাকিস্তান দ্রুত বাড়তে থাকা বাণিজ্য ঘাটতি ও কমতে থাকা বৈদেশিক রিজার্ভ নিয়ে মারাত্মক সঙ্কটে ছিল। প্যাকেজের মধ্যে ছিল ৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ ও ৩.২ বিলিয়ন ডলার তেল বাকিতে বিক্রি।
ওই সময় সৌদি আরব ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ পাকিস্তানকে ৬ বিলিয়ন ডলারের প্রণোদনা অনুমোদেনর আগে ওই অর্থ পাকিস্তানের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় ছিল।
পাকিস্তানি মিডিয়ার খবর অনুযায়ী, মে মাসে বাকিতে তেল বিক্রি বন্ধ করে দেয় সৌদি আরব। তারা ওই ঋণও পূর্ণ পরিশোধ করার তাগিদ দিয়েছিল।
দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক দ্রুত অবনতি হতে থাকে ফেব্রুয়ারিতে। ওই সময় কাশ্মীর ইস্যুতে সৌদি আরব ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলন আয়োজনে পাকিস্তানি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।
ইসলামাবাদ এটি মেনে নেয়নি। তারা জোর দিয়ে বলতে থাকে, কাশ্মীর ইস্যুতে ওআইসির মাধ্যমে ভারতকে চাপ দিতে হবে। এই প্রেক্ষাপটে সৌদি আরব ওই ঋণ ফেরত চায়।
ওআইসি ৫৭টি মুসলিম দেশ নিয়ে গঠিত। এটি প্রধানত সৌদি আরবের নিয়ন্ত্রিত।
কাশ্মীর নিয়ে ১৯৪৭ সাল থেকে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে বিরোধ চলে আসছে। উভয় দেশ এর অংশবিশেষ নিয়ন্ত্রণ করছে এবং পুরোটা নিজের বলে দাবি করছে।
চীন ১৯৬৩ সাল থেকে কাশ্মীরের আকসাই চিন অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ করছে। পরে কাশ্মীর প্রশ্নে চীন পাকিস্তানের অনুকূলে অবস্থান নেয়। এর রেশ ধরে সাম্প্রতিক সময়ে চীন ও ভারতের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশি অব্যাহতভাবে প্রকাশ্যেই বলছেন যে সৌদি আরবের উচিত হবে ওআইসি সম্মেলন আহ্বান করা।
গত সপ্তাহে এক টিভি সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, আমি আজ ওআইসিকে বলছি পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলন আয়োজন করতে। তারা যদি না ডাকে, তবে আমি প্রধানমন্ত্রীকে বলব, ইসলামি দেশগুলোর [ইরান, তুরস্ক ও মালয়েশিয়া] সম্মেলন আয়োজন করতে। তারা কাশ্মীর ইস্যুতে আমাদের পাশে থাকবে।
সর্বশেষ এই ঘটনার ফলে পাকিস্তানে ২০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের জন্য সৌদি আরবের সাথে হওয়া সমঝোতা স্মারক বাস্তবায়নও প্রশ্নের মুখে পড়েছে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সফরের সময় ওই সমঝোতা হয়েছিল।
প্রস্তাবিত বিনিয়োগের মধ্যে ছিল চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর সিপিইসির অন্যতম প্রকল্প গোয়াদার বন্দর এলাকায় ১০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের একটি তেল শোধনাগার নির্মাণ।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভারতকে সংযত করার জন্য পাকিস্তান ও চীন প্রয়াস চলানোর ফলে সৌদি আরব এখন আর ইসলামাবাদের প্রতি আগ্রহী নয়।
প্রাগের ইউনিভার্সিটি অব ইকোনমিক্সের ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের জ্যাঁ মাসারিক সেন্টারের সহকারী অধ্যাপক জেরেমি গারলিক বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করছে সৌদি আরব। যুক্তরাষ্ট্রই চীনা উদ্যোগ থেকে সরে আসতে পর্দার আড়াল থেকে সৌদি আরবের ওপর চাপ প্রয়োগ করছে।
তিনি বলেন, পাকিস্তান যেহেতু চীনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। আবার চীন ও পাকিস্তান উভয়ে ভারতের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ছে। কাজেই সৌদি আরবের পাকিস্তানকে সমর্থন দেয়া ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।
সিঙ্গাপুরের এস রাজারত্নম স্কুল অব ইন্টারন্যাশনালের সিনিয়র ফেলো জেমস এম ডোরসে বলেন, সৌদি ও ভারতের মধ্যকার ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক পাকিস্তানের প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের দেশটির মনোভাব বদলে দিচ্ছে।
তিনি বলেন, ভারতে সৌদি আরবের ব্যাপক বিনিয়োগ আছে। তারা সৌদি আরবের তেলের অন্যতম ক্রেতা। ফলে কাশ্মীর প্রশ্নে পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন হ্রাস করতে যাচ্ছে রিয়াদ।
অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সৌদি আরব কূটনৈতিক জটিলতায় আছে। তাদেরকে ভারসাম্য রক্ষার একটি পথ বের করতে হবে। তাদের মতে ইরানের কাছে হওয়ায় পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করা দরকার সৌদি আরবের।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, কেবল সৌদি আরবই নয়, বেইজিংও উদ্বিগ্ন। সৌদি তেল প্রয়োজন চীনাদেরও।
বেইজিংভিত্তিক অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ ইনার তানজেন বলেন, আদর্শগত নয়, বরং বাস্তব কারণেই ইসলামাবাদ-রিয়াদ সম্পর্কের ব্যাপারে দৃষ্টি রাখছে চীন।
তিনি বলেন, অর্থনৈতিক স্বার্থ সমুন্নত রাখতে চীনের প্রয়োজন স্থল ও সমদ্র রুটগুলো চালু রাখা। এ কারণেই আঞ্চলিক বিভক্তি চীনের স্বার্থের অনুকূলে নয়।
বিশ্লেষকেরা আশঙ্কা করছেন, ইসলামাবাদ-রিয়াদ দূরত্বের ফলে পাকিস্তান আরো বেশি করে চীনের ঘনিষ্ঠ হবে।
2021-05-04 20:07:02
0000-00-00 00:00:00