কাঠ পোকার পদত্যাগে গৃহিণীর উল্লাস – মিরান বিন রেহমান

বাংলাদেশের সরকারি আমলাদের আচরণ কাঠ পোকার আচরণের সাথে মিল রয়েছে। কাঠ পোকা কোনো ফার্নিচারের ভেতরে খেয়ে ঠোঙা বানিয়ে দিলেও উপরের বার্নিশ কিন্তু ঠিকই চকচক করে। ঘরের মালিকও তেমন গুরুত্ব দেয়না, কারণ, সে শুধু একটি গোল ছিদ্র-ই দেখতে পায়। গৃহিণী কখনো জানতে পারেনা যে, তাঁর আঁচল দিয়ে যত্ন করে মুছে রাখা ফার্নিচারটি ভেতরে ভেতরে তাসের ঘরে পরিণত হয়েছে। সেই ফার্নিচারটি নিয়ে সে গর্ব করে বেড়ায়, পাশের বাসার সাবিতা ভাবীকে বলে, ভাবী দেখেছেন, পাঁচ বছর হয়ে গেলেও আমার ফার্নিচারটা কেমন চকচক করছে!”

এদিকে দুর্নীতিবাজ আমলারা সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানকে ঘুন পোকার মত ভেতর থেকে এমনভাবে খায় যে, উপরের একটি ছিদ্র ছাড়া আর কিছুই মানুষ দেখেনা। দেখতো, যদি উক্ত ছিদ্র দিয়ে ঢুকতে পারতো। কিন্তু ১৯২৩ সালে ব্রিটিশদের রচিত অফিশিয়াল সিক্রেটস্ এক্ট নামক একটি কলোনিয়াল আইনকে বাংলাদেশ সরকার এখনো জিইয়ে রেখেছে, যে আইনে সরকারি অফিসের কোনো গোপনীয় বিষয় প্রকাশ করাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলা হয়েছে। এই আইন-ই সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্নীতির উক্ত ছিদ্রকে নিরাপত্তা দেয় আজও, ঠিক যেভাবে নিরাপত্তা দিত ব্রিটিশ কলোনিয়াল শাসকদের। তাই, যখন শাসকগোষ্ঠী কিছু লোকরঞ্জক অবকাঠামো তৈরি করার মাধ্যমে সেই ঘুনে-খাওয়া প্রতিষ্ঠানকে বার্নিশ করে, তখন গৃহিণীর মত অবোধ বাঙালিও সেই ঠোঙা প্রতিষ্ঠান নিয়ে গর্ব করে বলে, I live in digital Bangladesh.

কাঠ পোকা যেমন একটি ফার্নিচারকে ঠোঙা বানিয়ে অন্য আরেকটি ফার্নিচারে যায়, ঠিক তেমনিভাবেই সরকারি আমলারা একটি প্রতিষ্ঠানকে ঠোঙা বানিয়ে অন্য আরেকটি তরতাজা প্রতিষ্ঠানে চলে যায়, যেন স্বাদে ভিন্নতর কিছু যুক্ত হয়। আর এ প্রাতিষ্ঠানিক পালাবদলটি করে পদত্যাগ, প্রত্যাহার, ওএসডি নামক ইত্যাদি নাটকের মাধ্যমে। এ পদত্যাগের সবচেয়ে উপকারী দিক হলো, ত্যাগকৃত প্রতিষ্ঠানে করে আসা যাবতীয় পাপ-মার্জনা, সাথে সমসাময়িক সমালোচনা থেকেও বাঁচা যায়। টি এন্ড টি ফোনের লাইন কেটে দিলে যেমন কথাবলার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানে একজন আমলাকে বদলি করা হলে উক্ত প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় লুটপাটের তথ্যও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

কিছুদিন আগে স্বাস্থ্য সচিব আসাদুল ইসলামকে স্বাস্থ্যসেবা খাতের নানারকম অনিয়মের সাথে জড়িত থাকার কারণে বদলি করে পরিকল্পনা বিভাগের সচিব হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে। ফলাফল কী? ফলাফল হলো, বিগত সময়ে দুর্নীতির অভিযোগগুলোকে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়া হয়েছে, তাঁর উপরের দোষীদের রক্ষা করা হয়েছে, অবোধ বাঙ্গালিকে বুঝ দেয়া হয়েছে যে -অন্যায় করলে সে যত বড় পদেই থাক, ছাড় দেয়া হবেনা। সংসদেও কম গলাবাজি হয়না এসব লোকদেখানো ঠোঙা বিচার ব্যবস্থা নিয়ে।

ডিজি হেলদ্ আবুল কালাম আজাদের পদত্যাগও ঠিক একইরকম একটি লোক দেখানো নাটক। এ পদত্যাগের মাধ্যমে সে প্রচলিত নিয়মে নিজেকে দায়মুক্তি দিতে সক্ষম হয়েছে। সাথে রক্ষা করেছে তাঁর উপর মহলকে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের খাঁজে খাঁজে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটকে, সর্বোপরি সরকারকে। এই পদত্যাগের নাটকে অভিনয়ের জন্য সে কত টাকা পেয়েছে তাও একটা বিষয়। উন্নত দেশগুলোতে হলে তাঁকে এ মুহূর্তে পদত্যাগ করতে দিত না। স্টেপ-প্রিন্টের শার্টের কলার চেপে ধরে বলত, কিসের পদত্যাগ? মগের মুল্লুক পাইছ? অধিদপ্তরের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব বুঝায়ে দিয়ে তুমি জাহান্নামে গিয়ে মরো, আগে হিসাব, পরে পদত্যাগ।

কিন্তু পোস্ট-কলোনিয়াল যুগের নব্য দাসেরা তাঁর পদত্যাগ নিয়ে যেভাবে উল্লাসে আত্মহারা হয়ে গেছে, মনে হচ্ছে যেন বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসে গেছে, বিগত সময়ে লুটপাটের হাজার হাজার কোটি টাকা যেন ফিরে পেয়েছে, যেন চিকিৎসা না পেয়ে অগণিত মৃত মানুষগুলো আবারও আমাদের মাঝে ফিরে এসেছে।

আমরা সবসময় পরিবর্তনের কথা বলি। রাষ্ট্র ব্যবস্থার পরিবর্তন, শোষণ নীতির পরিবর্তন, বিদেশ নীতির পরিবর্তন, আরও কত কী। আসলে পরিবর্তনটা প্রথমেই করা উচিত আমাদের মানসপটে। নব্য দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে বের হওয়ার জন্য আমরা যদি স্রষ্টা-প্রদত্ব আমাদের বোধশক্তিকে ব্যবহার না করি, সমস্যার মূলরোমে করাত চালাতে না-পারি, আমাদের মুক্তি অসম্ভব। মক্ষিরানী ও তাঁর ভ্রমর বাহিনী আমাদেরকে শোষণ করে যাবে যুগ যুগ ধরে।

2021-01-30 06:29:31

0000-00-00 00:00:00

Published
Categorized as 17

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *