এভারেস্ট উচ্চতা পরিমাপ নিয়ে নেপালের সাথে চীনের খসড়া চুক্তিতে ভারতে উদ্বেগ

মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা পরিমাপ নিয়ে নেপাল ও চীনের মধ্যে দৃশ্যমান নির্বিষ খসড়া সমঝোতাটি ভারত সরকারের মধ্যে সতর্ক ঘণ্টা বাজাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট লোকজন জানিয়েছে।

দিল্লীর উদ্বেগের কেন্দ্রে রয়েছে চুক্তির একটি ধারা। এতে বেইজিং ও কাঠমান্ডুর মধ্যে জরিপ, মানচিত্র প্রণয়ন ও ভূ-তথ্য ব্যবস্থাপনায় যৌথ সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে। এর মাধ্যমে দেশ দুটি সম্পর্কিত তথ্য বিনিময় ও সমন্বয়ের একটি ফোকাল পয়েন্ট প্রতিষ্ঠা করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

জরিপ ও মানচিত্র প্রণয়নে সাধারণ সহযোগিতা নিয়ে বেশ উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে। এতে করে নেপালের কৌশলগত এলাকাগুলোতে চীনা কার্যক্রম বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২০১৯ সালের অক্টোবরে নেপাল সফরের সময় প্রণীত যৌথ ঘোষণায় বিশ্বের উচ্চতম পর্বতটি আবার পরিমাপ করার কথা বলা হয়। এতে ওই পর্বতকে নেপাল ও চীনের মধ্যকার শ্বাশত বন্ধুত্বের প্রতীক হিসেবে অভিহিত করা হয়।

নেপালের জন্য এভারেস্টের উচ্চতা সবসময়ই একটি স্পর্শকাতর বিষয়। এই পরিমাপ জাতীয় গর্বের প্রকল্প বিবেচিত। কেবল এভারেস্টে আরোহণের অনুমতির মাধ্যমেই নেপাল সরকার ৪ মিলিয়ন ডলার আয় করে। এছাড়া কুলি, গাইড ও পর্যটন শিল্পের বিপুল বিস্তৃত অর্থনৈতিক নেটওয়ার্কও রয়েছে।

জানা গেছে, চীন সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত অর্জিত সাফল্যকে ধরে রাখতে চায়। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে ভারতীয় এক সরকারি কর্মকর্তা বলেন, ঘোষণাই যদি হয়ে যায়, তবে চীন কেন সমঝোতা স্মারকের জন্য নেপালকে চাপ দিচ্ছে?

খসড়া চুক্তির শিরোনামের একটি কপি দি ওয়্যারের কাছে এসেছে। একে অভিহিত করা হয়েছে ‘জয়েন্ট এনাউন্সমেন্ট অব দি হাইট অব মাউন্ট ঝুমালাঙ্গমা/সাগরমাথা।’ ধারণা করা হয়েছে, নেপালের ভূমি ব্যবস্থাপনা, সমবায় ও দারিদ্র্য দূরীকরণ মন্ত্রণালয় ও চীনের প্রাকৃতিক সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে চুক্তিটি হয়েছে।

নেপালে চীনের আরো ব্যাপক উপস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ

জরিপ করা ও মানচিত্র প্রণয়ন করার ব্যাপারে সহযোগিতার বিষয়টি নয়া দিল্লীকে উদ্বিগ্ন করছে। উল্লেখ্য, নেপালে চীনের বৃহ্ত্তর উপস্থিতি নিয়ে ভারত সরকার ইতোমধ্যেই উদ্বেগে রয়েছে।

নয়া দিল্লি ধারণা করছে, প্রধানমন্ত্রী কে পি ওলির সরকার বেইজিংয়ের প্রতি বেশি বন্ধুপ্রতীম। মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা ধরা হয় ৮,৮৪৮ মিটার। ১৯৫৪ সালে সার্ভে অব ইন্ডিয়া এই পরিমাপ করে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশ তাদের নিজস্ব হিসাব কষেছে, কিন্তু কোনোটিই গ্রহণযোগ্য হয়নি।

চীন ইতোমধ্যেই সর্বোচ্চ চূড়াটি পরিমাপের দুটি উদ্যোগ নিয়েছিল। শেষ মিশনটি নিয়ে নেপালের সাথে দীর্ঘ বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল।

চীন ২০০৫ সালে ঘোষণা করেছিল যে এভারেস্টের সর্বোচ্চ চূড়াটির উচ্চতা ৮৮৪৪.৪৩ মিটার। এটি গ্রহণযোগ্য পরিমাপের চেয়ে চার মিটার কম। চীনা হিসাবের ভিত্তি ছিল রক হাইট। আর নেপাল চূড়ায় থাকা স্নোক্যাপের হিসাব অন্তর্ভুক্ত করার ওপর জোর দিয়েছিল। ২০১০ সালে দুই দেশের মধ্যে একটি সমঝোতা হয়। এর আলোকে মাউন্ট এভারেস্টের দুটি পরিমাপকেই গ্রহণ করা হয়, একটি পাথরের ভিত্তিতে, আরেকটি বরফের ভিত্তিতে।

তারপর ২০১৫ সালের ভূমিকম্প উচ্চতার প্রশ্নটি নতুন করে সামনে নিয়ে আসে। ভূমিকম্পের ফলে সর্বোচ্চ চূড়াটির উচ্চতা হ্রাস পেয়েছে বলে মনে হতে থাকে।

নেপাল সরকার ২০১৭ সালে ২.৫ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে নিজস্ব উদ্যোগে পরিমাপের ব্যবস্থা করে। ভারত ওই সময় যৌথ সহযোগিতার প্রস্তাব দিলেও নেপাল তা প্রত্যাখ্যান করে। নেপালের জরিপ বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তা এটিকে আত্মসম্মানের বিষয় হিসেবে অভিহিত করেছিলেন।

জরিপ বিভাগের ওই কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে হিন্দুস্তান টাইমসে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছিল, চীনও সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। আর নেপাল যদি সহযোগিতা চায়, তবে চীন ও ভারত, উভয়ের কাছ থেকে সহযোগিতা গ্রহণ করবে।

নেপালের ওই জরিপ দলটি ২০১৯ সালে এভারেস্টের চূড়ায় পৌছে। তারা পরিমাপের ৭৫ ভাগ কাজ শেষ করেছে বলে জানানো হয়েছে। ২০২০ সালে তারা ফলাফল প্রকাশ করবে।

জরিপকারীদের বিস্ময়

এই প্রেক্ষাপটে ২০১৯ সালের অক্টোবরে চীন ও নেপাল যৌথভাবে জরিপ করবে বলে ঘোষণা করায় জরিপকারীদের মধ্যে বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়। যৌথ ঘোষণার ১০ দিন পর নেপাল ভূমি ব্যবস্থাপনা, সমবায় ও দারিদ্র্য দূরীকরণ মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র কাঠমান্ডু পোস্টকে বলেন, আমরা এ ব্যাপারে কিছুই জানি না।

নেপালি কলামিস্ট অমিশ রাজ মুলমি বলেন, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে তা করা হচ্ছে। এতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক প্রতিফলিত হয়েছে।

করোনাভাইরাসের মধ্যেই চলতি বছরের মে মাসে চীন তার নিজস্ব জরিপ দলটিকে নেপাল পাঠায়। চীনা একাডেমি অব সার্ভেয়িং অ্যান্ড ম্যাপিং ইনস্টিটিউট অব জিওডেসি অ্যান্ড জিওডায়নামিক্সের পরিচালক দং ইয়ামিন দাবি করেছেন, ২০১৫ সালের ভূমিকম্পে পর্বতটির ওপর কী প্রভাব পড়েছে, তা নির্ণয়ের জন্যই জরিপের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

চীন ও নেপালের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৫ সালে। প্রথম কয়েক বছর এভারেস্টের সার্বভৌমত্ব নিয়ে এই দুই দেশের মধ্যে বিরোধ ছিল। ১৯৬১ সালে রাজা মহেন্দ্র ও চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান লিও শাওকির মধ্যে সীমান্ত চুক্তি হয়। এতে এভারেস্টের চূড়া দিয়ে সীমান্তরেখা অতিক্রম করেছে বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়। দুই দেশের মধ্যকার বিরোধপূর্ণ ১১টি চূড়ার মধ্যে ১০টিই পায় নেপাল।

চীনের ভূমি সীমান্ত আলোচনা নিয়ে এমআইটি অধ্যাপক এম টেলর ফ্রাভেল দাবি করেছেন যে তিব্বতের নিরাপত্তা নিয়ে উত্তেজনা নির্মূল করার জন্য নেপালের দাবি মেনে নিয়েছিল চীন। মিয়ানমারের সাথেও সীমান্ত চুক্তি করেছিল চীন। তারা চেয়েছিল, একই চেতনায় ভারতের সাথেও সীমান্ত বিরোধ মিটিয়ে ফেলতে।

এভারেস্টের সার্বভৌমত্ব ঝুঁকির মুখে না পড়লেও নেপালি জাতীয়তাবাদী গর্বের কাছে পর্বতটির গুরুত্ব বোঝা যায় চীনা রাষ্ট্রায়ত্ত ওয়েবসাইট সিজিএনটিতে মে মাসে এভারেস্টকে তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের বলে জানালে। এতে নেপাল ক্ষুব্ধ হয়। তখন সিজিটিএন তা সংশোধন করে এভারেস্টকে চীন-নেপাল সীমান্ত হিসেবে অভিহিত করে।

2021-05-04 18:08:03

0000-00-00 00:00:00

Published
Categorized as 18

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *