জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ডের ভিডিওটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় দেশগুলোত বর্ণবাদ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়েছে। ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ড যেন বর্ণবিদ্বেষ ও বৈষ্যমে ক্লান্ত একটি পৃথিবীর প্রতিচ্ছবি, যা করোনার ভয়াল আক্রমণকেও ম্লান করে দিয়েছে। ফ্লয়েডের মৃত্যুকালীন শব্দগুলো শুধু বাঁচার আকুতি নয়, এটি কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি মার্কিন সমাজের নিপীড়ন ও বর্ণবাদী আচরণের ইতিহাসকেও মনে করিয়ে দেয়।
সহজ ভাষায় বর্ণবাদ হচ্ছে নিয়মতান্ত্রিক নিপীড়ন যা এক বর্ণের গোষ্ঠী আরেক গোষ্ঠীর ওপর আধিপত্য বিস্তারে ব্যবহার করে। হাজার বছর ধরে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে বর্ণ নিয়ে পক্ষপাতমূলক মনোভাব বিদ্যমান ছিল, তবে নিয়মতান্ত্রিকভাবে বর্ণবাদী নিপীড়ন শুরু হয় ১৬ শতকে পুঁজিবাদ বিস্তারের মাধ্যমে। ১৬ শতকের আগে নিয়মতান্ত্রিক বর্ণবাদের অস্তিত্ব না থাকলেও অনেক সংস্কৃতিতে সামরিক বিজয়ের ফলস্বরূপ দাসপ্রথা প্রচলিত ছিল। কিন্তু যখন ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা আবিষ্কার করলো তাদের উন্নত প্রযুক্তি, জাহাজ ও আগ্নেয়াস্ত্র আফ্রিকায় সম্পদ আহরণে বিশেষ সুবিধা দিচ্ছে, তখনই তারা দাসপ্রথাকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে। ক্রীতদাস মালিকেরা দাসত্ব চর্চাকে ন্যায়সঙ্গত করার জন্য কিছু ভ্রান্ত ধারণা ছড়িয়ে দিয়েছিল। দাসদের মনে গেঁথে দেওয়া হয়েছিল দাসত্ব বরণ করার আগে তাদের কোনও পূর্ব সংস্কৃতিতো ছিলই না, তারা ছিল বর্বর। ট্রান্স আটলান্টিক ক্রীতদাস ব্যবসার শুরু থেকেই ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকরা আফ্রিকানদের কৃষ্টি ধ্বংস করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত থাকলেও নিজেদের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য ক্রীতদাসদের শারীরিক শ্রমকে পূর্ণভাবে ব্যবহার করতে দ্বিধা করেনি। ঔপনিবেশিকরা বাধ্য করেছিল আফ্রিকানদের তাদের ভাষার ব্যবহার ও ধর্মের অনুশীলন বন্ধ করতে। ধীরে ধীরে উপজাতি প্রথা ও পারিবারিক বন্ধনগুলোকে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। যার ফলে আফ্রিকানরা আর উইরোবা, ইগবো বা মালিয়ান হিসেবে চিহ্নিত হতে পারেনি বরং নিগার, নিগ্রো কিংবা কৃষ্ণাঙ্গ নামে পরিচিতি পেয়েছে। ইউরোপীয়-আমেরিকানরা কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর তাদের অর্থনৈতিক শোষণকে যুক্তিযুক্ত করার জন্য ‘শ্বেতাঙ্গরা শ্রেষ্ঠ জাতি’ বলে একটি মনগড়া বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব বাজারজাত করেছিল। এভাবে কৃষ্ণাঙ্গদের নিম্ন মর্যাদার জাতি হিসেবে চিহ্নিত করার মাধ্যমে ঔপনিবেশিক সমাজগুলো বৈষম্যমূলকভাবে তাদের দাস হিসেবে ব্যবহার করেছিল এবং নিজেদের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে সুদৃঢ় করেছিল।
১৮ শতকে দক্ষিণ আমেরিকার ক্রীতদাস প্রথা এবং পশ্চিম ইউরোপীয়দের ঔপনিবেশিকতা ও রাজত্ব বিস্তারের প্রতিটি স্তরে ছিল বর্ণবাদ। আফ্রিকান বংশোদ্ভূতরা যাদের পূর্ব পুরুষগণ দাসত্ব বরণ করে আমেরিকায় স্থানান্তরিত হয়েছিল তাদের সঙ্গে ইউরোপীয় বংশোদ্ভূতদের পার্থক্য সুস্পষ্ট করার জন্য বর্ণের ভিত্তিতে জাতিগত বিভাজনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। আফ্রিকান এবং আফ্রিকান-আমেরিকান বংশোদ্ভূতদের নিম্ন প্রজাতির মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করতে পুঁজিবাদী ও দাসত্বের প্রবক্তরা দাসত্ব প্রথাকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা অব্যাহত রাখে।
১৮৬১-১৮৬৫ সালে সংগঠিত আমেরিকার গৃহযুদ্ধের অন্যতম কারণ ছিল দক্ষিণ আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কনফেডারেন্সি গঠন করে দাসপ্রথা বজায় রাখার চেষ্টা। দক্ষিণ আমেরিকার শ্বেতাঙ্গরা তাদের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে সচল রাখার জন্য এবং কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে দাসত্ব প্রথা বজায় রাখার জন্য গৃহযুদ্ধে নেমেছিল।
১৯ শতকে বিশ্বজুড়ে বর্ণবাদ ছড়িয়ে পড়ে এবং অনেক দেশের রাজনৈতিক নেতারাও সেই সময়ে ধর্ম, ভাষা এবং বর্ণের ভিত্তিতে সমাজের মানুষকে উচ্চ ও নিম্নস্তরে বিন্যাস করেছিলেন।
ঔপনেবিশকতার সঙ্গে বর্ণবাদী শ্রেষ্ঠত্বের এই বহিঃপ্রকাশ এবং ঔপনিবেশিক ও সমাজের শোষিত শ্রেণির মধ্যে বিরাট পার্থক্য সুস্পষ্টভাবে সমাজে বৈরিতার জন্ম দিয়েছিল। ইউরোপীয় সমাজের এই বিভাজন নিয়মতান্ত্রিকভাবে বজায় রাখার জন্য ইউরোপীয়রা ক্রমান্বয়ে নিজেদের শ্বেতাঙ্গ হিসেবে চিহ্নিত করা শুরু করে। আমেরিকান শ্বেতাঙ্গদের আইনি উপায়ে কিংবা সামাজিক অনুমোদনের মাধ্যমে যে সকল অধিকার দেওয়া হয়েছিল তা আবার কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য অস্বীকার করা হয়। রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায় শ্বেতাঙ্গরা শিক্ষা, অভিবাসন, ভোটাধিকার, নাগরিকত্ব কিংবা সম্পদ অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ায় একচেটিয়া সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। যারা প্রকাশ্যে বর্ণবাদের চর্চা করছিলেন তাদের মধ্যে ধারণা ছিল যে নিম্নবর্ণের সদস্যদের নিম্নস্তরের চাকরিতে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত এবং সকল প্রকার রাজনৈতিক ক্ষমতা, অর্থনৈতিক সংস্থান কিংবা নাগরিক অধিকারের একচেটিয়া অনুমোদন শুধু উচ্চবর্ণের শ্বেতাঙ্গদেরই থাকবে।
১৯৫০ থেকে ১৯৬০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিভিল রাইটস মুভমেন্টের সময়ে বর্ণবাদ ক্রমবর্ধমান সমালোচনার মুখে পড়ে এবং পর্যায়ক্রমে আফ্রিকান-আমেরিকানদের বিরুদ্ধে সংগঠিত জাতিগত বিভেদ কিংবা বৈষম্যমূলক আইন ও নীতিগুলোকে ধীরে ধীরে দূর করা হয়। যেমন ১৯৬৪ সালে মার্কিন সংবিধানের চব্বিশতম সংশোধনীর মাধ্যমে জাতিগত সংখ্যালঘুদের ভোটদানের ক্ষমতা রহিতকরণের আইনগুলো বাতিল করা হয়। ক্রমান্বয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের বর্ণবাদ সম্পর্কে ধারণার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে। যদিও এবিসি নিউজ ও পিউ গবেষণাকেন্দ্রের সমীক্ষায় দেখা গেছে যে আধুনিক আমেরিকানদের বিশাল একটি অংশ স্বীকার করে যে তারা বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি রাখেন। সমাজের অনেক স্তরে এখনও বর্ণবাদী বৈষম্য বিদ্যমান রয়েছে, যা জাতিগত সংখ্যালঘুদের দৈনন্দিন জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। বর্ণবাদের জীবন্ত অভিজ্ঞতার মধ্যে শারীরিক নির্যাতন, প্রতিদিনের বৈষম্য ও অসম্মানের মৌখিক অভিব্যক্তি কৃষ্ণাঙ্গদের আত্মসম্মান ও সামাজিক জীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। পিউ গবেষণা কেন্দ্রের সমীক্ষায় দেখা গেছে ৬৩% কৃষ্ণাঙ্গ-আমেরিকান মনে করেন আজও মার্কিন সমাজে বর্ণবাদ বহুলাংশে তাদের অবস্থানকে প্রভাবিত করে। ৪৫% বেশি প্রাপ্তবয়স্ক কৃষ্ণাঙ্গ মনে করেন সমঅধিকারের ক্ষত্রে দেশটি ততটা এগিয়ে যায়নি। ২০১৫-২০১৬ শিক্ষাবর্ষে মোট মার্কিন শিক্ষার্থীদের মধ্যে ১৫% কৃষ্ণাঙ্গ শিক্ষার্থী তালিকাভুক্ত ছিল। ২০১৩-২০১৭ সালে প্রায় ৪০% শ্বেতাঙ্গ রোগী কৃষ্ণাঙ্গদের চেয়ে উন্নত স্বাস্থ্যসেবা পেয়েছেন। অন্যদিকে কৃষ্ণাঙ্গরা শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে প্রায় ২৫% কম উপার্জন করেন। একই অপরাধে দোষী সাব্যস্ত শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের চেয়ে কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষরা ১৯% বেশি দীর্ঘ শাস্তি পান। প্রায় ৮৭% কৃষ্ণাঙ্গ মনে করেন তারা ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় অন্যায্য আচরণ সহ্য করেন।
জাতিগত বিভাজন এবং শ্বেতাঙ্গদের আধিপত্য বজায় রাখতে আবাসন, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যসেবা এবং আইনপ্রয়োগের ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক নীতিগুলো আফ্রিকান-আমেরিকান সম্প্রদায়কে ক্ষতিগ্রস্ত করে প্রতিনিয়ত। জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ড মার্কিন সমাজের নিয়মতান্ত্রিক বৈষম্য এবং কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি নিপীড়নের ধারাবাহিকতাগুলো তুলে ধরেছে, যা ১৬১৯ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বিদ্যমান। এটি প্রমাণ করে দাসত্বের উত্তরাধিকার কিংবা বর্ণবাদী মনোভাব এখনও অনেক মার্কিনিকে অনুরণিত করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর অন্যতম কারণ হচ্ছে অতীতের ভ্রান্তিকে অস্বীকার এবং অগ্রগতির ওপর অগাধ বিশ্বাস। যেখানে রুয়ান্ডা, জার্মানি কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকা তাদের অতীত ভুলকে স্বীকার করেছে সেখানে মার্কিন যক্তরাষ্ট্র তাদের অতীতকে উপেক্ষা করে তথাকথিত উন্নয়নকে প্রাধান্য দিয়েছে। উন্নয়ন এবং বর্ণবাদের বিরুদ্ধে মানবিক ভাবধারা বিকাশের মধ্যে যথাযথ সমন্বয় সাধন করা হয়নি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, এখনও অনেক মার্কিনি বিশেষত কট্টরপন্থীরা কনফেডারেট সৈন্য ও রাজনীতিবিদ যারা বর্ণবাদকে জীবিত রাখতে চেয়েছিল তাদের বীর হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর অনেক দেশে বর্ণের ভিত্তিতে মানুষের অধিকার রক্ষায় সাংবিধানিক বা আইনি ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও অনেকের ব্যক্তিগত বিশ্বাস বা উপলব্ধি এখনও বর্ণবাদীই রয়ে গেছে। এই বর্ণবাদী মনস্তত্ত্ব যে একবিংশ শতকেও তথাকথিত উন্নত সমাজে বিদ্যমান তা ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়েছে। আবারও প্রমাণিত হয়েছে, শুধু উন্নয়ন ও আইনের মাধ্যমে বর্ণবাদী মনস্তত্ত্বকে দূর করা যায় না। তাই মানুষে মানুষে বর্ণের পার্থক্যের বিশ্বাসকে পরির্বতন করে কীভাবে সকলের সমমর্যাদা নিশ্চিত করা যায়, তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। মানবিকতা, মানবাধিকার ও সমমর্যাদা নিশ্চিতে বিশ্বনেতাদের সংখ্যালঘু ও সবিধাবঞ্চিতদের আর্তচিৎকার ‘আই কান্ট ব্রিদ’ শুনতে হবে ও প্রতিকারের সমস্ত পদক্ষেপ নিতে হবে—যর্থাথ সময় এখনই।
লেখক: (ব্যারিস্টার) আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। মানবাধিকারকর্মী