আল-জাজিরার নিউজ নিয়ে একপক্ষ এই কথা বলতে চাইছে যে, বিরোধী দল বিশেষত জামাত বিএনপি চক্রান্ত করছে অসাংবিধানিক উপায়ে মুক্তি যুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে ক্ষমতা চ্যুত করতে। তারা খুব চমৎকার ভাবে দুটা শব্দ ব্যবহার করেছে- (১) অসাংবিধানিক উপায়ে (২) মুক্তি যুদ্ধের পক্ষের শক্তি
ইতিহাস সাক্ষী ১৯৭১ এর মুক্তি যুদ্ধের পেছনের মূল কারণ ভোটের অধিকার না পাওয়া।
আমাদের সংবিধান যে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যবস্থা রাখে নাই সেটি বোধ করি শিশুতেও বুঝে। আজকে যারা বারগম্যানকে গালি দিতে গিয়ে বারবার বারগম্যানের বউ ও শ্বশুরের নাম বলছেন। এর পেছনের নিগড় কারণ বিদ্যমান। তারা ইনিয়ে বিনিয়ে দায়টা চাপিয়ে দিতে চাইছেন সংবিধান রচয়িতা কমিটি প্রধান ড. কামাল হোসেনের উপর। সংবিধান নিশ্চয় একটা কমিটিই লিখবে কিন্তু সংবিধান গ্রহণ করবে বা বর্জন করবে আলোচনা পর্যালোচনা করে মহান সংসদ। কমিটি লিখল আর সংবিধান হয়ে গেল এমনটি নয়। ১৯৭২ সালে আমাদের বাংলাদেশে সংবিধান সেই মহান সংসদেই গৃহীত হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের সংসদ নেতা স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতিতেই মাত্র ১৪ দিনের আলোচনা পর্যালোচনায়। এবং এই মহান সংবিধানের বিপক্ষে সেই সময় অবস্থান নেয়া সাংসদ সুরঞ্জিত সেন গুপ্তকে কি ভাবে ম্যানেজ করা হয়েছিল সে সবার জানা।
আমাদের ১৯৭২ সালের পবিত্র সংবিধান যে শান্তিপূর্ণ ভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের পথ খোলা না রাখলেও এই মহান সংবিধান প্রধানমন্ত্রীর আজ্ঞাবহ করে রেখেছে সে বিষয়ে বলবার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের সংবিধানে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের কোন পথ খোলা নাই বলেই আমাদের দেশে বার বার ফিরে আসে সেনা শাসন এবং আমাদের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে বারবার রাস্তায় নেমে আসতে হয়। আমাদের দেশের প্রধান দুই দলের বিরোধী নেতাদের জেলখানায় আশ্রয় নিতে হয় ক্ষমতা বদলের আন্দোলনে নেমে ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে। বাংলাদেশের প্রধান দুই দলের দল প্রধান শেখ হাসিনা ওয়াজেদ ও বেগম খালেদা জিয়া এর জেল বন্দি হওয়া তারই সাক্ষ্য বহন করে।
শেখ হাসিনা ওয়াজেদ ও বেগম খালেদা জিয়া এর জেল বন্দি ও রাস্তার আন্দোলনের মাধ্যমে সুস্থ ভোট ব্যবস্থার লক্ষে গৃহীত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। বর্তমানের ক্ষমতাসীন দল সে ব্যবস্থার মাধ্যমেই নির্বাচিত হয়েই বাতিল করে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা। কারণ তারা সংবিধানের সেই ফাঁকটাই কাজে লাগাতে চায় জোর করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়। তাদের এই অসৎ উদ্দেশ্য তারা সংবিধানের দোহাই দিয়েই জায়েজ করতে চায় তারা সংবিধানের দুর্বলতা দূর করে একটা গণতান্ত্রিক ভোট ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে চায় না।
এবার আশা যাক ‘মুক্তি যুদ্ধের পক্ষের শক্তি’ প্রসঙ্গে-
পূর্ব বাংলায় (পূর্ব পাকিস্তান) ছাত্র গণ বিক্ষোভের কারণে সকল নেতাদের ১৯৬২ সংবিধান বিরোধী প্রতিক্রিয়া, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ারদীর নয় নেতার সমর্থনে বিবৃতি এর সাথে ’৬৬ ছয় দফা ও ১১ দফা পরিস্থিতি ঘোলা করে তোলে, নিয়ে যায় গণ অভ্যুত্থানের দিকে শহীদ হন আসাদ। ২৪শে মার্চ ১৯৬৯ গণ অভ্যুত্থানের পর ২৫ মার্চ আইয়ুব খানের নিকট থেকে জেনারেল ইয়াহিয়া ক্ষমতা গ্রহণ করে(ন) ২৮ নভেম্বর ১৯৬৯ শর্ত সাপেক্ষে ০৫ অক্টোবর জাতিয় পরিষদ ও ২২ অক্টোবর ১৯৭০ প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন হবে। ১৯৭০ সালের ২৮ মার্চ ইয়াহিয়া খান এই নির্বাচনের ‘আইনি কাঠামো’ (Legal Framework Order – LFO) জানান দেন শর্ত ছিল –
(১) জন প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। জনপ্রতিনিধিদের কাজ হবে ১২০ দিনের মধ্যে সংবিধান প্রস্তুত করা। ব্যর্থতায় পরিষদ বাতিল।
(২) নির্বাচন শেষে প্রেসিডেন্ট (জেনারেল ইয়াহিয়া) তার পছন্দমতো দিন, সময় ও স্থানে অধিবেশন আহবান করবেন।
(৩) শাসনতন্ত্র (সংবিধান) প্রণয়নের পর তা প্রেসিডেন্ট এর নিকট অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করা হবে।
(৪) শাসনতন্ত্র (সংবিধান) বিলে প্রেসিডেন্ট অনুমোদন না দিলে জাতিয় পরিষদ বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
(৫) শাসনতন্ত্র (সংবিধান)বিলে অনুমোদনের আগে প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন ডাকা যাবে না।
**(৬) এল এফ ও এর কোন বিশয়ে ব্যাখ্যার প্রয়োজন হলে তা একমাত্র প্রেসিডেন্ট দিবেন এবং প্রেসিডেন্ট এর ব্যাখ্যায় চূড়ান্ত।
**(৭) প্রেসিডেন্ট এল এফ ও এর বিষয়ে যে ব্যাখ্যা দিবেন তা কোন আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না।
**(৮) প্রেসিডেন্টের এল এফ ও এর যে কোন ধারা সংশোধন বা পরিবর্তন করতে পারবেন এবং এ বিশয়ে জেতয় সংসদের হস্তক্ষেপ মূলক কোন ক্ষমতা থাকবে না।
উপরন্তু শাসনতন্ত্রে কি কি বিষয় থাকবে তার কিছু কিছু বলে দেয়া ছিল এই এল এফ ও তে।
মুক্তিযুদ্ধ: ভোট হল – নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন হল – সংসদ অধিবেশন নিয়ে টালবাহানা শুরু হল {পাকিস্তান সরকার ঠিক জায়গায় আছে তার এল এফ ও এর শর্ত অনুসারে (২ দেখুন)} – ২৫ শে মার্চ কাল রাত্রি ১৯৭১ – মুক্তি যুদ্ধ – বিজয় – দেশ স্বাধীন ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ – বাংলাদেশ।
স্বাধীনতা উত্তর (বাংলাদেশ) পর্ব: ১০ই জানুয়ারি ১৯৭২ মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন। ১১ই জানুয়ারি ১৯৭২ অস্থায়ী সংবিধান আদেশ জারি –
(১) স্বাধীনতার ঘোষণা পত্রে সকল ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে অর্পণ করা হয়েছিল ছিল সেটি বদলিয়ে প্রধান মন্ত্রীর হাতে ন্যস্ত।
(২) প্রেসিডেন্ট তার সকল কাজ প্রধান মন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী করবেন।
(৩) Coistituent Assembly-র সংজ্ঞা প্রণয়ন
২৩ মার্চ ১৯৭২ Constituent Assembly Order জারি করা হয় এবং এটিকে ২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকেই কার্যকর বলে ঘোষণা করা হয়। ১৯৭০ সালের জাতিয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে নির্বাচিত নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে Constituent Assembly গঠন ঘোষণা করা হয়।
অন্য একটি গণপরিষদের সদস্য পদ বাতিল খারিজ সম্পর্কিত একটি আইন The Bangladesh Constitutent Assembly Members (Ceassation of Membership) Order – 1972 জারি করা হয় ২৩ মার্চ ১৯৭২। এই আইনে প্রধান দুটি বিশয় উল্লেখ যোগ্য –
(১) আইনটিতে Constitutent Assembly-কে শুধু শাসনতন্ত্র (সংবিধান) প্রণয়নেরই দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল, এর বাহিরে কোন আইন প্রণয়ন করবার ক্ষমতা তাহাদের ছিল না।
(২) রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞা দিয়ে বলা হয়, যদি কোন গণপরিষদ সদস্য তিনি যে দলের মনোনয়নে নির্বাচিত হয়েছেন সে দল থেকে পদত্যাগ করেন বা দল তাকে বহিষ্কার করে তবে তার সদস্যপদ বিলুপ্ত হবে এবং এ বিষয়ে কোন আদালতে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না।
আছে কোন উত্তর: বেশ লক্ষণীয় একটি বিষয় ১৯৭০ সালের ২৮ মার্চ পাকিস্তানের স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এই নির্বাচনের ‘আইনি কাঠামো’ (Legal Framework Order – LFO) এর সাথে মুক্তি যুদ্ধের বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ The Bangladesh Constitutent Assembly Members (Ceassation of Membership) Order – 1972 জারি করা আইনের সাথে কোনই তফাৎই পাওয়া যায় না। উভয় আইনই বেশ জোর দিয়ে বলে যে, (ক) এই আইনগুলির বিপক্ষে আদালতে কোন চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। (খ) পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। (গ) পাকিস্তানের এলএফও সরাসরি যে কথা বলে বাংলাদেশের The Bangladesh Constitutent Assembly Members (Ceassation of Membership) Order – 1972 সেই কথায় বলে একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এনিয়ে বিনিয়ে।
এখন যারা আল-জাজিরার খবরকে বিশ্লেষণ করে বলতে চাইছেন স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি অসাংবিধানিক উপায়ে সরকারকে ক্ষমতা চ্যুত করবার পায়তারা করছেন তারা কি ঠিক বলছে?
মুক্তি যুদ্ধের বাংলাদেশ মানে- সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার বাংলাদেশ কি আমরা বানাতে পেরেছি? আমরা যদি দেশটাকে মুক্তি যুদ্ধের বাংলাদেশ বানাতে চাই তবে- সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার বাংলাদেশ বানানো ছাড়া ভিন্ন কোন পথ কি খোলা আছে?
আদীল
ঢাকা
*সুত্রঃ বাংলাদেশের সংবিধান পর্যালোচনা
2021-03-15 20:38:19
2021-03-15 09:38:19