আজ গণতন্ত্র হত্যা দিবস

নিজস্ব প্রতিবেদক: ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচন, ২১৩ কেন্দ্রে শতভাগ, ৫৮৬ কেন্দ্রে সব ভোট নৌকা মার্কায়গণতন্ত্র হত্যা দিবস আজ
একাদশ সংসদ নির্বাচনের ভোট ডাকাতির তৃতীয় বর্ষ আজ। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর আগের রাতে সারাদেশের বেশিরভাগ ভোট কেন্দ্র দখল করে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা রাতভর ভোট দিয়ে ব্যালট বাক্স ভরে রাখে। ভোটের দিন শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ ও তাদের সমর্থকদের কেন্দ্রে ঢুকতে দেয়া হয়েছিল। বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ভোট কেন্দ্রে যেতে বাধা দেয়া হয়েছে। 
বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সে নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে। বাংলাদেশের গণমাধ্যম, বিবিসিসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আগের রাতে ভোট দেয়ার খবর ফলাও করে প্রচার করে। সে নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলো। তারা ব্যাপক ভোট কারচুপির তদন্ত দাবি করে। বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হয়েছে, একতরফা নির্বাচন আয়োজন করার জন্য বিএনপি চেয়ারপারসন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মিথ্যা সাজানো মামলায় সাজা দিয়ে বন্দি করে, হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা, গায়েবি মামলা দিয়ে নির্বাচন ময়দানকে ফাঁকা করে ভোট ডাকাতির নির্বাচন আয়োজন করে ফলাফল আওয়ামী লীগের অনুকূলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।  
বাংলাদেশে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রকাশিত কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলে অস্বাভাবিক ভোট পড়ার চিত্র উঠে আসে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসিতেও। টিআইবি সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচনের ফলাফল জাতির সামনে তুলে ধরে। ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কমপক্ষে ২১৩টি কেন্দ্রে ১০০ শতাংশ ভোট পড়েছে। আর অন্তত ১ হাজার ৮৮৯টি কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৯৫ শতাংশ থেকে ৯৯.৯৯ শতাংশ। ৫৮৬ কেন্দ্রে সব ভোট নৌকা মার্কায়। এসব কেন্দ্রে ধানের শীষ কিংবা অন্য প্রার্থী কোনো ভোটই পাননি। এটা একটা হাস্যকর ব্যাপার। যেটা হয় না পৃথিবীতে, কোথাও এত ভোট পড়ার নজির নেই। এদিকে জাতীয় নির্বাচনের এত ভোট পড়ার তথ্য থাকলেও অনেকে ভোট দিতে পারেননি এমন অভিযোগ করেছেন বেশিরভাগ ভোটার। 
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ- টিআইবি ৫০টি আসন পর্যবেক্ষণ করে ৪৭টিতে বুথ দখল করে জাল ভোট, এমনকি ভোটের আগে ব্যালটে সিল মারার মতো অনিয়মের প্রমাণ রয়েছে। মূলত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগের রাতে প্রশাসনের লোকেরাই নৌকায় সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরে রেখেছে। পরের দিন ১০ শতাংশ লোকও ভোট দিতে পারেনি। অনেকে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ব্যালট পেপার না থাকায় ভোট না দিয়েই ফিরে গেছে। 
নির্বাচন পর্যবেক্ষণের সঙ্গে যুক্ত বেসরকারি সংস্থারা উদ্বেগ প্রকাশ করে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় কোথাও ৭০ শতাংশের বেশি ভোট পড়লেই সেখানে কমিশনের আলাদা নজর দেয়া উচিত। ফেমার প্রেসিডেন্ট মুনিরা খান বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনে ভোটের হার এত বেশি কেন সেটা নির্বাচন কমিশনকেই তদন্ত করে দেখার প্রয়োজন। ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট বেশিরভাগ আসনে জয় পেয়ে সরকার গঠন করেছে। আর বিরোধী ২০ দলীয় জোটে নেতৃত্বে থাকা বিএনপি এবং তাদের নির্বাচনি জোট ঐক্যফ্রন্ট মাত্র ৭টি আসনে জয় নিয়ে এখন সংসদে। 
একাদশ নির্বাচনে ভোট ডাকাতি হয়েছে অভিযোগ করে ঘোষিত ফলাফল বাতিল ও  অবিলম্বে পুনঃনির্বাচনের দাবি জানিয়েছিল বিএনপি। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, সে নির্বাচনে ভোট কারচুপির বিষয়টি আগে থেকেই ছিল সুপরিকল্পিত। ইঞ্জিনিয়ারিং করা হয়েছে ভোটের আগের রাতে। এ নির্বাচনে জনগণকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। এ নির্বাচনে ভীতি ছাড়া কিছু ছিল না। পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে একেবারে বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে আমাদের প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করে যে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে নজিরবিহীনভাবে একটা যুদ্ধাবস্থা তৈরি করে ত্রাস-ভীত সৃষ্টি করে এই নির্বাচনটি করা হয়েছে। 
তিনি বলেন, এই নির্বাচন যেটা নজিরবিহীন সন্ত্রাস, রাষ্ট্র্রীয় সন্ত্রাস এবং ভোট ডাকাতি বলা যেতে পারে, এই ভোট ডাকাতির ফলে আমরা এই নির্বাচনের ফলাফলকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছি। আমরা মনে করি, এই কলঙ্কজনক নির্বাচন বাতিল করে পুনরায় অনুষ্ঠিত করতে হবে এবং এটা অনতিবিলম্বে নির্বাচন করতে হবে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে।
৩০ ডিসেম্বরকে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে বিএনপি। 
৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের রাতে অর্থাৎ ২৯ ডিসেম্বর ‘ভোট ডাকাতি’ হয়েছে। তাই ৩০ ডিসেম্বর দিনটিকে দেশবাসী ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে পালন করে। পৃথিবীর ইতিহাসে অভাবনীয় রেকর্ড সৃষ্টিকারী রাতে র‌্যাব-পুলিশের সহায়তায় ব্যালট বাক্স পূর্ণ করে ক্ষমতা দখলের তিন বছর পূর্ণ হয়েছে। তাই ঐ রাতটি দেশবাসীর কাছে তাদের ভোটাধিকার হরণের কালো রাত হিসেবে কলঙ্কিত হয়ে থাকবে। ২০১৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর কালো রাতে মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেয় আওয়ামী লীগ। সেদিন গণতন্ত্রের গলায় ফাঁসির দড়ি ঝুলিয়েছিল। তাই ৩০ ডিসেম্বর কোনো ভোট হয়নি, যা হয়েছে তা হলো নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগের সম্মিলিত উদ্যোগে ভোট ডাকাতি। 
বাংলাদেশসহ সারা বিশে^র গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে ভোট ডাকাতির নির্বাচনের খবর ফলাও করে প্রচার হয়েছে। আসলে ৩০ ডিসেম্বর শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদেররা যা করেছেন তা গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিরুদ্ধে ‘ডার্টি ওয়ার’। এই অভিনব ও নজিরবিহীন নিশিরাতের নির্বাচন করে অনুশোচনার বালাই নেই বরং গত পরশু দিন ওবায়দুল কাদের সাহেব বলেছেন ‘বিএনপি তখন সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা ব্যাহত ও বাধাগ্রস্ত করতে এবং গণতন্ত্রকে সংকটে ফেলতে চেয়েছিল।’ আদিম মানুষরা নরবলি দেয়ার পর মৃতদেহ নিয়ে যেভাবে উল্লাস করতো ওবায়দুল কাদেরের এই বক্তব্য যেন গণতন্ত্র হত্যা করে সেই ধরনের উল্লাসেরই বহিঃপ্রকাশ। গণতন্ত্র হত্যা করে গণতন্ত্রের প্রতি এহেন শ্রদ্ধাহীন স্পর্ধার সংস্কৃতিতে দেশবাসী আজ চরমভাবে ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ। এই নির্বাচনের পর নব্য নাৎসীরা দাঁত বের করেছে হিংস্রভাবে। 
তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান অথচ সিইসি নুরুল হুদার নেতৃত্বে যে কমিশন সেই কমিশনের অধীনে আজ পর্যন্ত একটি নির্বাচনও সুষ্ঠু হয়নি। মানুষের ভোটের অধিকারকে এই কমিশন শুধু হরণই করেনি বরং মহান স্বাধীনতার মূল চেতনা গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে তারা গুরুতর অসদাচরণ করেছেন। নির্বাচন কমিশনের এই ভূমিকা জনগণের বিরুদ্ধে সরকারের নির্দয় মনোবৃত্তির সারাংশ মাত্র। 
দেশের ৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিক ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’ গঠন করে ইসির ভোট ডাকাতি, অনিয়ম ও দুর্নীতির যে তদন্তের দাবি জানিয়েছেন এবং তাদের বিচার দাবি করেছেন- এ দাবি দেশের ১৬ কোটি মানুষের দাবি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণের প্রকাশ করা কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল বিশ্লেষণেও প্রমাণিত হয়েছে যে, একাদশ নির্বাচনের প্রকাশিত ফলাফল ছিল সম্পূর্ণ বানোয়াট। 
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যে ফলাফল নির্বাচন কমিশন প্রকাশ করেছে তাতেই জানা গেছে, ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। এটি কোনোভাবেই স্বাভাবিক ও বাস্তবসম্মত নয়। কারণ ওইসব কেন্দ্রের বহু মানুষ বিদেশে রয়েছেন, অনেকে মারা গেছেন কিংবা অনেকে কেন্দ্রেই যাননি। এছাড়া ওই ফলাফলে জানা যায়, ৫৯০টি কেন্দ্রে বৈধ ভোটের শতভাগ কেবলমাত্র একটি প্রতীকেই পড়েছে। এটিও অবিশ্বাস্য। এসব অবাস্তব ও অস্বাভাবিক ঘটনা সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনের কোনো ব্যাখ্যা নেই। 
এছাড়া ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীরা এক হাজার ১৭৭টি (মোট কেন্দ্রের ২.৯৩ শতাংশ) কেন্দ্রে, লাঙ্গল প্রতীক তিন হাজার ৩৮৮টি (মোট কেন্দ্রের ৮.৪৪ শতাংশ) কেন্দ্রে, হাতপাখা প্রতীক দুই হাজার ৯৩৩টি (মোট কেন্দ্রের ৭.৩০ শতাংশ) কেন্দ্রে কোনো ভোটই পাননি, এটিও কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ফলাফলের এমন অস্বাভাবিকতা নির্বাচন কমিশনের গুরুতর অসদাচরণেরই প্রতিফলন। নির্বাচন নিয়ে নির্বাচন কমিশন ও সরকারি দলের বক্তব্য যখন এক হয়ে যায় তখন সেই নির্বাচন কমিশন যে সরকারের গোলাম হয়েই কাজ করছে তাও প্রমাণিত হয়েছে। 
একাদশ সংসদ নির্বাচনের ভোটের দিনের নানা অনিয়মের চিত্র তুলে ধরে বিবিসি বাংলার এক সাংবাদিক চট্টগ্রাম-১০ আসনের একটি কেন্দ্রে সকালে ভোটগ্রহণ শুরুর আগেই ব্যালট বাক্স ভরা দেখতে পান। ভোট গ্রহণের সারাদিনই পত্র-পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ধরনের অনিয়মের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। নির্বাচনের পর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) পরিচালিত এক জরিপেও আগের রাতে সিল মেরে রাখার অভিযোগ উঠে আসে। দৈবচয়নের ভিত্তিতে নির্বাচিত ৫০টি আসনের মধ্যে ৩৩টি আসনেই আগের রাতে সিল মেরে রাখার ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছে টিআইবি। 
এছাড়া খুলনা, গাজীপুর, সিলেট, বরিশাল ও রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিভিন্ন অনিয়ম এবং এসব নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের অসৎ অনাচারের অভিযোগও জানান দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা। সুতরাং ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’ গঠন করে ইসির ভোট ডাকাতি, অনিয়ম ও দুর্নীতির বিচার করার জন্য দেশের বিশিষ্ট নাগরিকগণ যে দাবি জানিয়েছেন, সে দাবির পাশাপাশি ভোট ডাকাতির নির্বাচনে যে সরকার গঠিত হয়েছে সেই আওয়ামী সরকারের এই মুহূর্তে পদত্যাগ দাবি করছি।

2022-04-09 16:37:13

2022-04-09 06:37:13

Published
Categorized as 17

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *